সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ: মহামারিতে সাশ্রয় ২৫০০ কোটি টাকা

অনলাইন ডেস্ক: মেঘের কোলেই থাকে রোদের ঝিলিক। কোভিড-১৯ মহামারির ক্ষেত্রেও বিষয়টা এমনই। গত বছরের মার্চ থেকে এই করোনা মহামারিই সরকার ও জনগণের প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা বাঁচিয়ে দিয়েছে।

২০২০-২১ অর্থবছরে কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের খরচ মেটানোর জন্য সরকার দুই হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছিল। এর আগের অর্থবছরের তুলনায় যা ৭০ কোটি টাকা বেশি।

কিন্তু গত বছরের জানুয়ারির শুরুতে মহামারির জন্য আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল হয়ে যাওয়ায় মিটিং, সেমিনার, প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার মতো বৈশ্বিক ইভেন্টগুলো স্থগিত হয়ে যায়।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এ কারণে এই খাতে বরাদ্দ ২ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করা সম্ভব হয়নি। তার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরেও প্রায় ৫০০ কোটি টাকা বেঁচে গিয়েছিল।

বিদেশ ভ্রমণের খরচ আসে রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেট থেকে। কর্মকর্তাদের মধ্যে বিদেশ ভ্রমণের ঝোঁক অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকার দরুন প্রতি বছর এই খরচ বেড়েই চলেছিল। কিন্তু মহামারি এটাকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে এনেছে।

গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কোডিভ রোগী শনাক্ত হয়।

গত বৃহস্পতিবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক পরিপত্রে ভ্রমণ খাতে বরাদ্দ অর্থের ৫০ শতাংশ বাতিলের পাশাপাশি সব রুটিন ট্যুর বাতিলের অনুরোধ জানায়।

এতে বলা হয়, কেবলমাত্র জরুরি প্রয়োজন ও অনিবার্য পরিস্থিতিতে এই অর্থ খরচ করা যাবে।

মহামারির কারণে মিতব্যায়িতার আরেকটি উদ্যোগের অংশ হিসেবে একই দিনে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আরেকটি পরিপত্রে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের গাড়ি কেনার জন্য বরাদ্দ খরচ ৫০ শতাংশে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়।

বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রকল্পের কর্মকর্তার প্রতি বছর নানা প্রশিক্ষণ, মিটিং ও সেমিনারে অংশ নেওয়ার জন্য বিদেশে যান। বিদেশ ভ্রমণের ব্যাপারে মন্ত্রীদেরও ঝোঁক দেখা যায়।

কিছু ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ তৈরি করে সেখানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তাদের যুক্ত করে থাকে। প্রকল্পের জন্য যাদের আসলে কিছুই করার থাকে না।

সরকারি কর্মকর্তাদের এমন ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণের প্রবণতা নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। দেখা যায়, জনগণের পয়সায় এমন অনেক ভ্রমণের ক্ষেত্রে কোনো ফলাফল আসে না। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এমন ঘন ঘন বিদেশযাত্রার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন।

করোনাভাইরাস মহামারি গত বছরের পুরো সময় জুড়ে এই ধরনের ভ্রমণ খরচের লাগাম টানতে সক্ষম হয়েছিল।

গত বছরের জানুয়ারিতেই সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের মাত্রা কমে আসতে থাকে। মার্চে দেশে প্রথম কোভিড রোগী শনাক্ত হওয়ার পর তা কার্যত বন্ধই হয়ে যায়।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা এ বিষয়ে বলেন, ‘দু-একজন মন্ত্রী বাদে এ সময়ের মধ্যে এই খাতে আর কারও তেমন কোনো খরচই হয়নি।’ ওই কর্মকর্তা জানান, গত বছরের মার্চ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয় বিদেশ ভ্রমণ সংক্রান্ত কোনো ফাইল কর্মকর্তাদের কাছ থেকে গ্রহণ করেনি।

সাধারণত মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পর্যায় পর্যন্ত কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের ফাইলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী সই করেন। এই পদমর্যাদার ওপরের কারও ফাইলে প্রধানমন্ত্রীর সই দরকার হয়।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা বলেন, গত অক্টোবরে ভারত মেডিক্যাল ভিসা দেওয়া শুরু করার পর ব্যক্তিগত খরচে দেশটিতে চিকিৎসার জন্য সরকারি ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা কয়েকটি ফাইল অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিলেন।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানান, কেবল সিকিউরিটিজ ও এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যানের একটি ফাইল ছাড়া বিদেশ ভ্রমণের আর কোনো ফাইলে তাকে সই করতে হয়নি।

অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমি নিজে চিকিৎসার জন্য তিন বার দেশের বাইরে গিয়েছিলাম। কিন্তু এর সব খরচ আমি নিজেই বহন করেছি।’

এ সময়ের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনও দু-একবার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ভ্রমণের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস পরীক্ষা ও কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে বাধ্যতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকার অতিরিক্ত খরচের জন্য কর্মকর্তারা এখন আর বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে আগ্রহী হচ্ছেন না।

ওই কর্মকর্তা আরও জানান, যদিও এলডিসি থেকে উত্তরণের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরে কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের সম্ভাবনা আছে। তিনি মনে করেন, সরকারি কর্মকর্তাদের দেশের বাইরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার প্রয়োজন আছে। যাতে করে তারা সেখানকার ভালো চর্চাগুলোর বিষয়ে জ্ঞানার্জন করতে পারে।

মহামারির কারণে গত বছর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিশ্ব ব্যাংকের বার্ষিক এবং বসন্তকালীন সভা ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই সভার মধ্য দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা ও অর্থমন্ত্রীরা বছরে দুবার একত্রিত হন।

এ ছাড়া দেশেও বছর জুড়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সভা ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নের ওপর তৈরি এক প্রতিবেদনেও বিদেশ ভ্রমণের জন্য বরাদ্দের বিষয়টি আলোচিত হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ, পরিকল্পনা বিভাগ, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক বিভাগ বিদেশ ভ্রমণের বরাদ্দের চাইতে কম খরচ করেছে।

গত সপ্তাহে জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের সভায় উপস্থাপিত ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশের বাইরে পূর্ব নির্ধারিত প্রশিক্ষণ, কর্মশালা ও সেমিনার বাতিল হওয়ার বিষয়টি খরচ কম হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ।

ভ্রমণ খরচের ক্ষেত্রে গন্তব্যের দেশগুলো তিন ভাগে বিভক্ত। আর সরকারের ঊর্ধ্বতনরা তাদের পদমর্যাদা অনুসারে ভ্রমণ ভাতা পেয়ে থাকেন।

এক নম্বর গ্রুপের দেশগুলো হচ্ছে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং ইউরোপ। দুই নম্বর গ্রুপে আছে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলো। আর এশিয়ার দেশগুলো আছে তিন নম্বর গ্রুপে।

গত বছর অর্থনৈতিক বিভাগের একটি পরিপত্র অনুসারে জাতীয় সংসদের স্পিকার, মন্ত্রী, সচিব, সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশি মিশনগুলোতে কর্মরত রাষ্ট্রদূতরা তাদের ‘বিশেষ স্ট্যাটাস’ অনুযায়ী হোটেল খরচ হিসেবে দৈনিক ২৩০ থেকে ৫৬০ ডলার পর্যন্ত ভাতা পান।

এ ছাড়া খাবার, বকশিশ ও যাতায়াতের জন্য তাদের দৈনিক ৮৭ থেকে ১২৭ ডলার পর্যন্ত ভাতা দেওয়া হয়।

এদিকে জেনারেল বা সাধারণ স্ট্যাটাসের আওতাধীন কর্মকর্তাদের হোটেল খরচের জন্য বরাদ্দ থাকে ১১৬ ডলার থেকে ২৮০ ডলার। অন্যান্য খরচ নির্বাহের জন্য তাদের ৬৪ ডলার থেকে ১০১ ডলার করে দেওয়া হয়।

এ ছাড়া মন্ত্রীরা বিনোদনের জন্য ৭০০ ডলার এবং প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীরা ৬০০ ডলার করে খরচ করতে পারেন। অন্যদিকে কেবিনেট সচিব, মূখ্যসচিব, জ্যেষ্ঠ সচিব, সচিব ও সম পদমর্যাদার সামরিক কর্মকর্তাদের এ বাবদ ৫০০ ডলার পর্যন্ত খরচের অনুমোদন আছে।