একাত্তর লাইভ ডেস্ক
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রফতানি পণ্যের বাজার বহুমুখী করার ওপর গুরুত্বারোপ করে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যকে ২০১৭ সালের জন্য ‘প্রডাক্ট অব দি ইয়ার’ (জাতীয়ভাবে বার্ষিক পণ্য) ঘোষণা করেছেন।
রোববার মাসব্যাপী ২২তম ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এ ঘোষণা দেন।
একই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ২০১৩-১৪ সালের দেশের সর্বোচ্চ রফতানি আয়কারী ৬৬টি প্রতিষ্ঠানের মাঝে জাতীয় রফতানি ট্রফি ও সনদ বিতরণ করেন।
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। খবর বাসসের
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘উদীয়মান চামড়া শিল্পখাতের অন্তর্নিহিত সকল সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর উদ্দেশে আমি আগামী ২০১৭ সালের জন্য চামড়া ও পাদুকাসহ চামড়াজাত পণ্যকে জাতীয়ভাবে বার্ষিক পণ্য বা প্রডাক্ট অব দি ইয়ার হিসেবে ঘোষণা করছি।’
বার্ষিক পণ্য ঘোষণার প্রেক্ষিতে এ পণ্যকে সব ধরনের সহযোগিতা ও প্রণোদনা প্রদানের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকলকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার শুধু পোশাক শিল্পের মধ্যে রফতানি আয়কে সীমাবদ্ধ না রেখে রফতানি পণ্যের বাজার বহুমুখী করার ওপর গুরুত্বারোপ করে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় তা আরও কার্যকর করার পন্থা অবলম্বন করেছে।
তিনি বলেন, বিগত সাড়ে চার দশকে চামড়া খাতে রফতানি প্রায় ৭১ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রথম সারির বৈশ্বিক পণ্যগুলোর চামড়াজাত পণ্য এখন বাংলাদেশেই প্রস্তুত হয়। এ পণ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য-সংযোজন সম্ভব হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বিশ্বের সাথে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এগিয়ে যাব সেই চিন্তা-চেতনা নিয়েই কিন্তু আমরা রাষ্ট্র পরিচালনা করে যাচ্ছি। অর্থনীতিকে আরো শক্তিশালী ও গতিশীল করার জন্য বেসরকারি খাতকে আমরা উন্মুক্ত করে দিয়েছি। বেসরকারি খাতের যেন পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে সেজন্য বিভিন্ন ক্ষেত্র যেমন, বিদ্যুৎ উৎপাদনকেও আমরা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের আগে কেবল সরকারি খাতেই বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো। যার পরিমাণ মাত্র ১৫শ’ থেকে ১৬শ’ মেগাওয়াট। প্রধানমন্ত্রী হয়ে আমি আইন পাশ করলাম। বেসরকারি খাতকে আমরা উন্মুক্ত করে দিলাম। প্রতিটি ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতে ব্যবসা-বাণিজ্যের আমরা আরো সুযোগ সৃষ্টি করে দিলাম।’
শেখ হাসিনা বলেন, সরকারি খাতের পাশাপাশি যখন বেসরকারি খাত সুযোগ পেল স্বভাবিকভাবে আজকে আমাদের অর্থনীতির মূল শক্তি হিসেবে বিকষিত হয়েছে বেসরকারি খাত।’
তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে আমি বলব, বেসরকারি খাতেরও যথেষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। ব্যবসায়ীরা নিজেরা ব্যবসা-বাণিজ্য করে কেবল নিজেরাই সম্পদশালী হবেন, আর বড় লোক হবেন সেই চিন্তা-ভাবনা যেন না থাকে। মনে রাখতে হবে আপনাদেরকে যে সুযোগ-সুবিধাগুলো দিচ্ছি অর্থাৎ আমরা সরকার হিসেবে ফ্যাসিলেটরের দায়িত্ব পালন করছি। আপনাদের সেই সুযোগ নিয়ে দেশের মানুষের কল্যাণ করতে হবে, দেশের মানুষের উন্নতি করতে হবে।’
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কামিটির সভাপতি মো.তাজুল ইসলাম চৌধুরী, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন ও এফবিসিসিআই সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমদ।
ইপিবি’র ভাইস চেয়ারম্যান মাফরুহা সুলতানা অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজকে যারা শিল্প কল-কারখানা গড়ে তুলবেন তাদের খেয়াল রাখতে হবে আমরা রফতানিকে গুরুত্ব দেই। আবার এটাও ভাবতে হবে আমার নিজের দেশে বাজার সৃষ্টি করতে হবে। নিজের দেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়াতে হবে। আজকে আমার দেশের মানুষের যদি আর্থিক স্বচ্ছলতা আসে আমার দেশের মানুষের যদি ক্রয় ক্ষমতা বাড়ে তাহলে মানুষ যেমন ভালো থাকবে তেমনি আপনাদের শিল্পের প্রসার ঘটবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শুধু দেশে নয়, এই সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় আপনারা যেন পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারেন সেই সুযোগটাও আমরাই সৃষ্টি করে দিয়েছি।’
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী তার বিবিআইএন (বাংলাদেশ, ভুটান, ইন্ডিয়া, নেপাল) এবং বিসিআইএম-ইসি’র (বাংলাদেশ, চিন, ইন্ডিয়া, মিয়ানমার- অর্থনৈতিক করিডোর) প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘এই পার্শ্ববর্তী ৪টি, ৪টি মোট ৮টি দেশের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের কারণে আমাদের দেশের শিল্পায়নও যেভাবে ঘটবে তেমনি পণ্যের বাজারজাত করণেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে।’
ব্যবসায়ীদের নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাজারই শুধু না কোন দেশের কোন এলাকায় কোন পণ্যের চাহিদা বেশি এবং কোন পণ্যের উৎপাদন আমাদের দেশে সম্ভব তা আপনাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে। সেই সাথে সাথে সেসব পণ্য আপনাদের উৎপাদন করে নতুন বাজার সৃষ্টি করতে হবে।’
তিনি জানান, ‘৯৬ সালে তার সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে সেখানে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করেন এবং পরবর্তী সময়ে জাপান এবং ভারতসহ প্রতিবেশী বেশ কয়েকটি দেশেও বেশ কিছু পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা হয়।
দেশের জনগণের ওপর আস্থা রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ তারা এত যোগ্য, তাদের মেধা এত ভালো একটু সুযোগ পেলেই তারা যেকোন পণ্য উৎপাদন করতে পারবে সে ধরনের সক্ষমতা বাংলাদেশের মানুষের আছে। তাদেরকে শুধু পথ দেখাতে হবে, ট্রেডিং দিতে হবে— এটাই আমি আপনাদের কাছে বলতে চাই।’
প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের বলেন, ‘আপনারা শুধু কয়েকটি দেশ ঘুরে ওই দেশ কেন জিএসপি দিল না সেজন্য স্যারদের পেছনে না ঘুরে আপনারা নিজেরাই অন্য বাজার খুঁজে বের করেন। তখন ওরাই আপনাদের পেছনে দৌঁড়াবে। কারণ আমাদের দেশ পণ্য যতটা দ্রুততার সঙ্গে সরবরাহ করতে পারবে অন্য দেশ তা পারবে না। কাজেই আমাদের ব্যবসায়ীদেরকেও সে উদ্যোগ নিতে হবে। বাজার খুঁজে ফেরা আর আমাদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রটা প্রসারিত করা।’
তিনি বলেন, “পৃথিবীর একশ’টি দেশে এখন আমরা পণ্য রফতানি করছি। আমাদের বহুপণ্য আজকে বিদেশে যাচ্ছে। বিশ্ব এখন পরিবেশ বিষয়ে সচেতন। যে কারণে পাট ও পাটজাত পণ্যের বিরাট একটা বাজার আজকে সৃষ্টি হয়েছে কারণ পাট হলো একটি কৃষি পণ্য। কাজেই পাট ও পাটজাত পণ্য যতটা উৎপাদন করা যায় তা আমরা বিদেশে রফতানি করতে পারি। পাট ও পাটজাত পণ্য নিয়ে গবেষণা করে আমরা পাটের জন্ম রহস্য যেমন উন্মোেচান করেছি তেমনি পাট নিয়ে গবেষণা করে পাটের বেশ কিছু প্রডাক্ট আমরা পেয়েছি, যেগুলো উৎপাদন করে বিদেশেও রফতানি করতে পারি আবার দেশের কাজেও লাগাতে পারি। যাতে করে কৃষকরাও লাভবান হবে। এভাবেই আমাদের রফতানিকে বহুমুখী করণ করতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী গবেষণার প্রতি গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘আপনারা ব্যবসায়ীরা ওই গতানুগতিক কিছু পণ্যের দিকে তাকিয়ে না থেকে কীভাবে পণ্যের বহুমুখীকরণ করা যায় সেদিকে নজর দেবেন।’
তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় এফবিসিসিআইয়ের একটি পৃথক গবেষণা সেল থাকা উচিত। যাদের কাজ হবে গবেষণা করা পৃথিবীর কোন দেশে কোন পণ্যের চাহিদা সেই পণ্য উৎপাদন করার মত সক্ষমতা আমাদের দেশের রয়েছে কি না, আমাদের কাঁচামাল আছে কি না, সেগুলি আমদানি করা। এ ধরনের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা যেতে পারে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেশকে যদি আমরা দারিদ্রমুক্ত করতে চাই তাহলে অন্যান্য দিকে থেকেও আমাদের এগোতে হবে। শিল্পায়নটাও দরকার। সে দিকেই লক্ষ্য রেখে আমরা একশ’টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় করে দিচ্ছি।’
প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের বলেন, ‘আপনারা যদি বিনিয়োগ করতে চান তাহলে এসব বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে করতে হবে কারণ সেখানে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব ধরনের সুবিধা আমরা সৃষ্টি করে দিয়েছি।’
যত্রতত্র শিল্প কারখানা স্থাপন করলে অনেক ক্ষেত্রেই সেখানে প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধাদি দেওয়া সম্ভব হয় না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী সরকার নির্দিষ্ট শিল্পাঞ্চলেই শিল্প কারখানা গড়ে তোলার পরামর্শ দেন।