একাত্তর লাইভ ডেস্ক:
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘জমিনকে আমার জন্য নামাজের স্থান ও পবিত্রকারী বানানো হয়েছে, যেখানেই নামাজের সময় উপনীত হয়, সেখানেই আমি তায়াম্মুম করে নামাজ পড়ি।’
তায়াম্মুমের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করা উম্মতে মুহাম্মদির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। আর কোনো নবীর উম্মতের জন্য এ বৈশিষ্ট্য বা ফজিলত ছিল না। হাদিস শরিফে এসেছে, হজরত হুজাইফা (রা.) থেকে বিধৃত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘তিনটি বিষয়ে আমাদের সমগ্র মানবজাতির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে। যথা ১. আমাদের (নামাজের) কাতারকে ফেরেশতাদের কাতারের মতো করা হয়েছে। ২. গোটা ভূপৃষ্ঠকে আমাদের জন্য নামাজের স্থান বানানো হয়েছে। ৩. আর মৃত্তিকাকে পবিত্রকারী করা হয়েছে, যখন আমরা পানি না পাই।’ (মুসলিম শরিফ : ১/১৯৯)। সাধারণত তেলাওয়াতে কোরআন, নামাজ ও বায়তুল্লাহ তাওয়াফের জন্য পবিত্রতা পূর্বশর্ত। আর এর মাধ্যম দুইটিÑ যথা পানি ও মাটি। পানি দ্বারা যেমনভাবে ‘হদসে আসগর’ তথা ছোট নাপাকি ও ‘হদসে আকবার’ তথা বড় নাপাকি দুই ধরনের নাপাকি থেকে পাক অর্জিত হয়। অনুরূপ মাটি দ্বারাও উভয় নাপাকি থেকে পবিত্রতা হাসিল করা যায়।
এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘এক ব্যক্তি রাসুল (সা.) এর উপস্থিতিতে আরজ করল, হে রাসুলুল্লাহ (সা.)! আমরা বালুময় এলাকায় বসবাস করি। আমাদের মধ্যে জুনুবি, নিফাস ও ঋতুস্রাবগ্রস্তা রয়েছে। এখন আমরা কী করব? তখন রাসুল (সা.) বললেন, তোমাদের ওপর মাটি আবশ্যক।’ অর্থাৎ, তোমরা মাটি দ্বারা পবিত্রতা হাসিল করো। (বায়হাকি শরিফ : ১/২১৬), (বাদায়েউস সানায়ে : ১/১৬৪)।
তায়াম্মুমের অর্থ : তায়াম্মুমের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, ইচ্ছা বা সংকল্প করা। পরিভাষায় এর পরিচয় হলো, পানি ব্যবহারে অক্ষমতা বা পানির অবর্তমানে নির্দিষ্ট কর্মের মাধ্যমে মাটি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত ফকিহ আল্লামা ইবনুল হুমাম (রহ.) বলেন, শরিয়তের পরিভাষায় তায়াম্মুম বলা হয়, ‘পবিত্র মৃত্তিকা দ্বারা মুখম-ল ও দুই হাত মাসেহ করা।’ (আশরাফুল হিদায়া : ১/১৮৫)।
তায়াম্মুমের বৈধতা : তায়াম্মুম কোরআন, হাদিস ও ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। পবিত্র কালামুল্লাহ শরিফে বর্ণিত হয়েছে, ‘যদি তোমরা রুগ্ণ হও অথবা প্রবাসে থাক অথবা তোমাদের কেউ প্রস্রাব-পায়খানা সেরে আসে অথবা তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে সহবাস কর, অতঃপর পানি না পাও, তবে তোমরা পাক মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করে নাও। অর্থাৎ, স্বীয় মুখম-ল ও হস্তদ্বয় মৃত্তিকা দ্বারা মুছে ফেল।’ (সূরা মায়েদা : ৬)। হাদিস শরিফে হজরত আবুজর গিফারি (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘পবিত্র মৃত্তিকা মুসলমানদের জন্য পবিত্রকারী, যদিও সে ১০ বছর পানি না পায়।’ (নাসাঈ শরিফ : ১/৩৬)। ওই হাদিসে ১০ বছর থেকে দীর্ঘ সময় উদ্দেশ্য। এমন নয় যে, নির্দিষ্ট ১০ বছর অভিপ্রায়। অর্থাৎ, যতদিন পানি না পাবে, ততদিন অবধি মৃত্তিকা তার জন্য পানির স্থলাভিষিক্ত। অপর এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘জমিনকে আমার জন্য নামাজের স্থান ও পবিত্রকারী বানানো হয়েছে, যেখানেই নামাজের সময় উপনীত হয়, সেখানেই আমি তায়াম্মুম করে নামাজ পড়ি।’ (বাদায়েউস সানায়ে : ১/১৬৪)।
তায়াম্মুমের সূচনা : উম্মত জননী হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সঙ্গে সফরে ছিলাম। যখন আমরা ‘বায়দা’ অথবা ‘জাতুল জায়েশ’ নামক স্থানে পৌঁছলাম, তখন আমার মাল্য হারিয়ে যায়। এতে রাসুলুল্লাহ (সা.) থেমে গেলেন এবং সেটি অন্বেষণ করতে লাগলেন। অন্য সাহাবিরাও তার সঙ্গে যাত্রা বন্ধ করলেন। সেখানে পানির কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এমনকি উপস্থিত কারও কাছে পানি ছিল না। এ অবস্থায় কিছু সাহাবি আবু বকর (রা.) সমীপে এসে নালিশ দিলেন, এ কি কাজ করল আয়েশা? তার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) এবং সাহাবিরা এমন জায়গায় দাঁড়াল, যেখানে কোনো পানির ব্যবস্থা নেই। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, এরপর হজরত আবু বকর আমার কাছে এলেন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) আমার উরুর ওপর মাথা দিয়ে শায়িত ছিলেন। তিনি বললেন, হে আয়েশা! তুমি রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তার সাহাবিদের এমন স্থানে আবদ্ধ করেছ, যেখানে না আছে পানির ব্যবস্থা আর না আছে তাদের কাছে কোনো পানি। আয়েশা (রা.) বলেন, আমার আব্বাজান আবু বকর আমাকে বকা দিলেন, আর আল্লাহ যা চাইলেন তাই বললেন। এক পর্যায়ে তিনি স্বীয় হস্ত দ্বারা আমার কটিতে বারবার আঘাত করতে লাগলেন, আমি নড়াচড়া না করে নীরব থাকলাম। কারণ রাসুলুল্লাহ (সা.) এর মাথা ছিল আমার রানের ওপর। সর্বশেষ রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রভাতে নিদ্রা থেকে জাগ্রত হলেন, তখনও পানির কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এ সময় আল্লাহপাক তায়াম্মুমের আয়াত অবতীর্ণ করেন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, যখন বহনকারী উষ্ট্রটি দাঁড়াল, তখন তার পাদদেশে হারিয়ে যাওয়া মাল্যটি পাওয়া গেল। (বোখারি : ১/৪৮)। তারপর থেকে তায়াম্মুমের সূচনা ঘটে। তবে উপর্যুক্ত ঘটনাটি কোন সনে সংঘটিত হয়েছে, এ ব্যাপারে কয়েকটি মতামত পাওয়া যায়। কেউ বলেছেন, ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছে চতুর্থ হিজরিতে। আবার কেউ বলেছেন, পঞ্চম হিজরিতে। আবার অনেকেই ষষ্ঠ হিজরির কথা ব্যক্ত করেছেন।
তায়াম্মুম বৈধ হওয়ার শর্ত : ১. তায়াম্মুম করার আগে তায়াম্মুমের নিয়ত করা। নিয়ত ব্যতীত তায়াম্মুম সহিহ হবে না। ২. তায়াম্মুম বৈধকারী কোনো ওজর বিদ্যমান থাকা। যেমন পানি এক মাইল বা তার চেয়ে বেশি দূরে, পানি ব্যবহারে রুগ্ণ বৃদ্ধি, তীব্র শীতের কারণে অঙ্গহানির আশঙ্কা, পানি উত্তলোনের রশি, বালতি উপস্থিত না থাকা, শত্রু, হিংস্র প্রাণী ও পিপাসার্ত হওয়ার ভয় থাকা ইত্যাদি। ৩. তায়াম্মুম মাটি জাতীয় কোনো পবিত্র বস্তু দ্বারা করা। যেমন, সুরকি, বালু, ধূলি, চুনা ও পাথর ইত্যাদি। ৪. পুরো মুখম-ল ও উভয় হাতকে কনুইসহ মাসেহ করা। ৫. অধিকাংশ বা পূর্ণাঙ্গ হস্ত দ্বারা মাসেহ করা। ৬. হাতের তালুর ভেতরের অংশ দ্বারা দুইবার পাক মাটিতে স্পর্শ করা। ৭. পানি বা মুখচ্ছবিতে পালিশ বা এ জাতীয় কোনো জিনিস থাকলে তা দূরীভূত করা। ৮. এমন কোনো জিনিস বিদ্যমান না থাকা যা তায়াম্মুম বৈধ হওয়ার জন্য প্রতিবন্ধক হয়। যেমনÑঋতুস্রাব বা কোনো ধরনের নাপাক বিদ্যমান থাকা ইত্যাদি।
তায়াম্মুমের পদ্ধতি : তায়াম্মুমের পদ্ধতি হলো, দুইবার পবিত্র মৃত্তিকায় উভয় হস্তকে মারবে। প্রথমবার মেরে পুরো মুখম-ল এবং দ্বিতীয়বার উভয় হাতকে কনুইসহ মাসেহ করবে। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, তায়াম্মুম হলো, দুইবার পাক মাটিতে হাত রাখা। একবার হাত রাখা হলো মুখম-লের জন্য আর দ্বিতীয়বার উভয় হাতের জন্য। (হিদায়া : ১/৩৩)।