নরসিংদীর জেনারেল-ডেন্টাল হাসপাতালের ভুল চিকিৎসায় অকাল মৃত্যুর শিকার মেধাবী ছাত্র মৃদুল

আসাদুল হক পলাশ, নরসিংদী থেকে: গায়ের আম পাড়া, জাম পাড়া সেই দুরন্ত শিশু মৃদুল আর বেঁচে নেই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ‘ক্লিনিক্যাললী ডেড’ (শাস্ত্রিক মৃত্যু) ঘোষণার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই রবিবার দুপুরে মৃদুল মারা গেছে। এর আগে নরসিংদী জেনারেল ও ডেন্টাল হাসপাতাল থেকে ভুল ও অপ চিকিৎসার কারণে সংকটাপন্ন অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অপারেশনের নামে অপচিকিৎসা তথা হাতুড়েপনা করে তাকে অকাল মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় নরসিংদী জেনারেল ও ডেন্টাল হাসপাতালের শল্য চিকিৎসক ডা. আসাদ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, শিবপুর উপজেলার ভরতেরকান্দী গ্রামের অটোচালক খোকনের পুত্র, ভরতেরকান্দী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র মৃদুল ছিল খুবই মেধাবী ও প্রাণবন্ত একটি শিশু। তার রোল নং ছিল ৪। লেখাপড়ার পাশাপাশি সে গাঁয়ের ছেলে মেয়েদের সাথে মিশে সারা দিন দূরন্তপনা করে বেড়াতো। গ্রামের মানুষ তাকে অত্যন্ত ভালবাসতো।

গাছ থেকে আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল ফলফলাদী পাড়তে হলে ডেকে আনতো মৃদুলকে। মৃদুল অত্যন্ত খুশী মনেই গ্রামের মানুষের কাজ করে দিয়ে আনন্দ ভোগ করতো। গত ২৭ মে শনিবার মৃদুল হঠাৎ মারাত্মক পেট ব্যথায় আক্রান্ত হয়। সাথে তার বমিও হতে থাকে। এই অবস্থায় মৃদুলের পিতা-মাতা তাকে ভরতেরকান্দী বাজারে সালাম ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যায়। সেখানে তার পেট ব্যথা কমানোর জন্য ডাক্তার তাকে ব্যাথানাশক টেবলেট খাওয়ায়।

এতে তার পেট ব্যথা আরো বেড়ে যায় এবং সে রক্ত বমি করতে থাকে। এই অবস্থায় একই দিন রাতে জনৈক বাতেন দালালের মাধ্যমে মৃদুলকে সালাম ডাক্তারের পরামর্শে তারই নিজ মালিকানাধীন বেসরকারী ক্লিনিক নরসিংদী জেনারেল ও ডেন্টাল হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে নিয়ে যাবার পর মৃদুলকে দেখে কর্তব্যরত সার্জন ডা. আসাদ জানান যে, তাৎক্ষণিকভাবে তার পেটে জরুরী অস্ত্রোপচার বা অপারেশন করা না হলে মৃদুলকে বাঁচানো যাবে না। ডাক্তারের কথায় মৃদুলের পিতা-মাতা ২৫ হাজার টাকা রফাদফায় অপারেশনে রাজী হয়।

এরপর রাতেই ডাক্তার আসাদ তাৎক্ষনিকভাবে মৃদুলকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে তার পেটে অস্ত্রোপচার করে সেলাই করে দেয়। পরদিন সকালে তার অবস্থা আরো সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় মৃদুলের নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বেরোতে থাকলে ডা. আসাদ ও সালাম ডাক্তারের পরামর্শে তাকে জরুরী ভিত্তিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে ভর্তি করার পর কর্তব্যরত ডাক্তাররা পরীক্ষা নিরিক্ষা করে জানায় যে, পেট ব্যাথা কমানোর জন্য এনালজেসিক জাতীয় ব্যাথানাশক ওষুধ প্রয়োগের কারণে মৃদুলের অন্ত্র বা নারী-ভূরিতে একাধিক পারপোরেশন বা ক্ষতের সৃষ্টি হয়।

এতে তার দেহে অভ্যন্তরে রক্তক্ষরন ঘটে। পরবর্তীতে জরুরী ভিত্তিতে অপারেশন করা হলেও আন্ত্রিক ক্ষতস্থানগুলোর সব জায়গায় অপারেশন করা হয়নি। শুধু তাই নয় অপারেশন শেষে ক্ষতস্থানে সেলাই’র কাজে যথাযথ নিয়ম না মানার কারণে কাটা ছেড়া জায়গা থেকেও রক্তপাত হতে থাকে। অতিরিক্ত রক্তাপাতের কারণে মৃদুল আশংকাজনকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে।

এই অবস্থায় তার চিকিৎসা দেয়া কঠিণ হয়ে যায়। এরপরও ঢাকামেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বেডে দীর্ঘ ১৪ দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ার পর সেখানকার ডাক্তাররা তাকে ‘ক্লিনিক্যাললি ডেড’ (শাস্ত্রিক মৃত্যু) ঘোষনা করে তাকে বাড়ী নিয়ে যাবার পরামর্শ দেন। এই অবস্থায় মৃদুলের পিতা-মাতা আত্মীয়রা তাকে হাসপাতাল থেকে ভরতেরকান্দী গ্রামে নিজ বাড়ীতে নিয়ে যায়। পথিমধ্যে মৃদুলের পিতা খোকন ও তার আত্মীয়রা নরসিংদী প্রেস ক্লাবে গিয়ে সাংবাদিকদেরকে নরসিংদী জেনারেল ও ডেন্টাল হাসপাতালের কীর্তিকলাপের ঘটনা বর্ণনা দেয়। সেখান থেকে গ্রামের বাড়ী ভরতেরকান্দী নিয়ে যাবার পর শত শত মানুষ মৃতপ্রায় মৃদুলকে দেখার জন্য ভীড় জমায়। এই অবস্থায় রবিবার দুপুর ১২ টায় মৃদুল মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে। মৃদুলের মৃত্যুর খবরে সারা গ্রাম তথা নরসিংদী জেলা শহরে শোকের ছায়া নেমে আসে।

উল্লেখ্য যে, নরসিংদী ডেন্টাল ও জেনারেল হাসপাতালটিতে ইত:পূর্বেও কয়েকটি ভুল চিকিৎসা জনিত দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ পর্যন্ত ২ জন গর্ভবতী মহিলা অপারেশন করতে গিয়ে হাতুড়েপনার কারণে মারা যায়। ভরতেরকান্দী গ্রামের মেয়ে জনৈক বেনুর কন্যা ইয়াসমিন হাসপাতালে সিজার অপারেশন করাতে গেলে ডাক্তাররা পেটের ভিতরে নেকড়া রেখেই পেট সেলাই করে দেয়। এমন বহুসংখ্যক অভিযোগ রয়েছে নরসিংদী ডেন্টাল ও জেনারেল হাসপাতালের বিরুদ্ধে। কিন্তু নরসিংদীর স্বাস্থ্য প্রশাসন এই ডেন্টাল হাসপাতালের বিরুদ্ধে কোন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না।