এনসিসির কাউন্সিলর বাবুর বিরুদ্ধে স্কুল থেকে পঞ্চাশ লাখ টাকা ‘ধার’নেওয়ার অভিযোগ

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি : নারায়ণগঞ্জ আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ থেকে পঞ্চাশ লাখ টাকা ‘ধার’ নিয়েছেন বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি এনসিসি কাউন্সিলর আব্দুল করিম বাবু। বিষয়টির প্রতিবাদ করায় কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে প্রতিষ্ঠান থেকে লাঞ্ছিত করে জোর করে বের করে দিয়েছে সে।

আর নিয়মনীতি উপেক্ষা করে সে পদে আসীন করিয়েছে প্রতিষ্ঠানের স্কুল শাখার সহকারি প্রধান শিক্ষককে। যদিও এ প্রতিষ্ঠানের কলেজ শাখায় এ সহকারি শিক্ষকের উপরে আরো বেশ কয়েকজন জেষ্ঠ শিক্ষক রয়েছেন। ডিস বাবুর এসব অপকর্মের প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন স্কুলের বিদ্যুৎসাহী সদস্য মোতহাহার হোসেন। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ স্কুলের গভার্নিং বডি জোর করে অবৈধ পন্থায় দখল করে সভাপতির পদে আসীন হয়েছেন বাবু।
প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন অভিভাবক ও শিক্ষক জানান, নারায়ণগঞ্জ আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের গভার্নিং বডির সভাপতি পদে রয়েছেন ১৭ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল করিম বাবু। গত ১৮ জানুয়ারী স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভায় গভার্নিং বডির সভাপতি আব্দুল করিম বাবু স্কুলের পূর্ব দিকের নির্মাণাধীন ভবনের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করার জন্য জোর করে পঞ্চাশ লাখ টাকা ধার নেয়।

এ সভায় উপস্থিত সদস্যদের সাথে তার এ নিয়ে প্রচন্ড বাক-বিতন্ডা হয়। গভার্নিং বডির সদস্যদের মধ্যে নাজমুন নাহার জলিকে তিনি সভা থেকে বের করে দেয়ার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে গভার্নিং বডির সদস্যদের দেখে নেয়ার হুমকি দেন। সভার আগেই সে সভার রেজুলেশন খাতায় সাক্ষর নিয়ে নেন। পরে নিজের লোক দিয়ে খাতায় টাকা ধার নেয়ার ব্যাপারে অনুমোদনের বিষয়টি লিখিয়ে নেয়। এ সভার পরদিন ১৯ জানুয়ারী আব্দুল করিম বাবু অগ্রনী ব্যাংকের বঙ্গবন্ধু রোড শাখা থেকে টাকা তুলে নেন।
অভিভাবক ও শিক্ষকর আরো জানান, ভবনটির নির্মাণ কাজ কাগজপত্রে পেয়েছে আকবর এন্ড সন্স। কিন্তু নেপথ্যে রয়েছে আব্দুল করিম বাবু। শুরুর দিকে সে বিষয়টি অস্বিকার করলেও সভাপতি হওয়ার পর থেকে সে বিষয়টি স্বিকার করছে। এ ভবন নির্মাণের জন্য মোট এক কোটি ৬৬ লাখ টাকা নির্মাণ ব্যায় ধরা হয়। এর মধ্যে এক কোটি টাকা নারায়ণগঞ্জ আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ ফান্ড থেকে দেয়া হবে এবং বাকি টাকা দান হিসেবে সংগ্রহ করা হবে বলে কলেজের কমিটির রেজুলেশন রয়েছে।

যখন এ রেজুলেশন করা হয় তখন এর গভার্নিং বডির সভাপতি ছিলেন জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান মিঞা। এ ভবন নির্মাণ বাবদ প্রথম দফায় চল্লিশ লাখ ও দ্বিতীয় দফায় পঞ্চাশ লাখ টাকা মোট নব্বই লাখ টাকা বিল নিয়ে নেয় সে। এ কাজের জামানত ছিলো দশ লাখ টাকা। কিন্তু পঞ্চাশ লাখ টাকা তুলে নেয়ার পর সে দাবী করছে ভবনের কাজ করার জন্য জমা দেয়া জামানতের দশ লাখ টাকাও এর মধ্যে রয়েছে। যদিও ভবনের কাজ এখনো শেষ হয়নি।
ঐ সভায় ও পরেও এ টাকা তুলে নেয়ার জোর প্রতিবাদ করেন স্কুলের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মনোয়ারা বেগম। এ কারনে প্রথমে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতন বন্ধ করে দেন আব্দুল করিম বাবু। পরে গত ১৪ মে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেন বাবু। তালা ঝুলানোর পরে স্কুলের সকল শিক্ষককে তার কাউন্সিলর কার্যালয়ে ডাকিয়ে নিয়ে মাফ চাইতে বাধ্য করেন। অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। এরপর তালা খুলে দেন ও শিক্ষকদের বেতন বিলে সাক্ষর করেন।

কিন্তু এরপরেও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ধার নেয়া টাকা ফেরৎ চাওয়ায় ও স্কুল ভবনের কাজ শেষ করার কথা বলায় গত ১৭ মে বাবু তার সহযোগী বিদ্যোৎসাহি সদস্য ও কমর আলি হাইস্কুলের গনিতের শিক্ষক মোহাতাহার হোসেনসহ তার লোকজন নিয়ে প্রতিষ্ঠানে এসে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে চিৎকার করে গালিগালাজ করতে থাকে। এক পর্যায়ে জোর করে তাকে অব্যহতি দিয়ে প্রতিষ্ঠানের চাবি রেখে বের করে দেয়।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মনোয়ারা বেগমকে বের করে দিয়ে প্রতিষ্ঠানের স্কুল শাখার সহকারি প্রধান শিক্ষক আব্দুল আজিজকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেয়। স্কুলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষকরা জানান, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী যেখানে এমপিওভূক্ত স্কুল ও কলেজ একসাথে রয়েছে সে ধরনের প্রতিষ্ঠানে সহকারি অধ্যাপকদের জেষ্ঠতার ভিত্তিতে তাদের মধ্য থেকে একজনকে প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগ করতে হবে।

স্কুল শাখার সহকারি প্রধান শিক্ষককে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ করার বিধান নেই। তবে এমপিওভূক্ত না হলে এসিষ্ট্যান্ট হেডমাষ্টার অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে। আদর্শ বালিকা স্কুল এন্ড কলেজ এমপিওভূক্ত। এ ছাড়া এ নিয়োগের ক্ষেত্রে স্কুলের গভার্নিং বডির অনুমোদন নেয়ার বিধান থাকলেও এক্ষেত্রে তা করা হয়নি।
এ প্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষ নিয়োগের জন্য ৮ এপ্রিল পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। এ অধ্যক্ষ নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেয়ার আগে গভার্নিং বডির কোনো সভা করা হয়নি। যদিও গভার্নিং বডির সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিজ্ঞাপনের প্রেক্ষিতে ১৬ জন নিয়োগ পাওয়ার জন্য আবেদন করেন। কিন্তু সবাইকে নিয়োগ পরীক্ষার চিঠি না দিয়ে মাত্র সাতজনকে নিয়োগ পরীক্ষার চিঠি দেয়া হয়।

গত ১৩ মে এ নিয়োগ পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু ঐদিন শিক্ষা অধিদপ্তরের ডিজি’র প্রতিনিধি ও জেলা শিক্ষা অফিসার অনুপস্থিত থাকায় পরীক্ষা নেয়া হয়নি। ১৭ মে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে জোর করে বের করে দিয়ে ঐদিন-ই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে সহকারি প্রধান শিক্ষক আব্দুল আজিজকে নিয়োগ নিয়ে পরদিন অধ্যক্ষ নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এ প্রক্রিয়াও অবৈধ বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন।ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি পদে আব্দুল করিম বাবু জোর করে আসীন হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ এর গভার্নিং বডি থেকে সম্ভাব্য সভাপতি হিসেবে জেলা প্রশাসক রাব্বি মিয়া, তোলারাম কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রভেসর আব্দুল কাদির ও ব্যাবসায়ী শেখ ওয়াজেদ আলী বাবুলের নাম প্রস্তাব করা হয়।স্থানীয় এমপি সেলিম ওসমান জেলা প্রশাসককে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি করার জন্য সুপারিশ করেন। কিন্তু আব্দুল করিম বাবু ভয়ভীতি দেখিয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের সাক্ষর আদায় করে নিজের নাম পাঠায়।
আব্দুল করিম বাবু নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্যসের ঘনিষ্ঠ জন হিসেবে পরিচিত। এমপি শামীম ওসমানের সাথে ঘনিষ্ঠতার দাপট তিনি প্রতিষ্ঠানে দেখান বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও এটি নারায়ণগঞ্জ পাঁচ আসনে পড়েছে।
এসব ব্যাপারে কথা বলতে আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ এর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মনোয়ারা বেগম বলেন, এ প্রতিষ্ঠানে কি হচ্ছে তা এলাকাবাসী, এখানকার গভার্নিং বডির সদস্যরা সবাই জানে। নিরাপত্তাজনিত কারনে আমি এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে চাইনা। বোর্ড বা জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে এ প্রতিষ্ঠানে তদন্ত করলে কোনো দূর্নীতি অনিয়ম থাকলে তা বের হয়ে আসবে।
বিদ্যুৎসাহী সদস্য মোতাহার হোসেন নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করে এসব অভিযোগের ব্যাপারে গভার্নিং বডির সভাপতি আব্দুল করিম বাবুর সাথে কথা বলতে বলেন। কাউন্সিলর ও ডিস ব্যবসায়ী আব্দুল করিম বাবু তার বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো টাকা ধার নেইনি।

সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মনোয়ারা বেগম স্বাধীনতা বিরোধী। সে কলেজে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করেনা, প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও কনফারেন্সের দিন সে উপস্থিত ছিলোনা। এ কারনে গভার্নিং বডির সিদ্ধান্তনুযায়ী তাকে বহিস্কার করা হয়েছে।

এসিসট্যান্ট হেড মাষ্টারকে ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল অনুযায়ী নিয়োগের বিষয়টি নিয়ম মেনে করা হয়েছে তিনি দাবী করেন। তিনি বলেন, গভার্নিং বডির কিছু সদস্য আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তারাই আমার বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের কাছে মিথ্যা তথ্য দিচ্ছে।
তার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মনোয়ারা বেগম জানান, আমি জাতির জনকের জন্মদিন উপলক্ষে প্রতিষ্ঠানে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা করেছি। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস পালন করেছি। আমার স্বামী মারা যাওয়ায় ও আমার মেয়ের এইচএসসি পরীক্ষার কারনে আমি প্রতিষ্ঠান থেকে ছুটি নিয়েছিলাম। এ ছুটির সময়ে প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। ফলে আমি উপস্থিত থাকতে পারিনি।