হেরা গুহায় আত্মগোপনে তিন দিন

একাত্তর লাইভ ডেস্ক:
নবীজি মক্কা ছেড়ে মদিনা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে আবু বকরের ঘরে আসেন। এরপর তার ঘরের পেছনের বেড়া দিয়ে বেরিয়ে যান। তারা সোজা পাহাড়ের একটি গুহায় চলে যান। গুহাটি ছিল মক্কার নিম্ন উপকণ্ঠে অবস্থিত সাওর পবর্তে। তারা সে পর্বতের গুহায় প্রবেশ করলেন। আবু বকর (রা.) তার ছেলেকে আদেশ দিয়েছিলেন, সারাদিন লোকজন তাদের ব্যাপারে কী বলাবলি করে তা যেন শোনে এবং দিন শেষে সন্ধ্যায় খবরাখবর তাদের কাছে পৌঁছায়। তার খাদেম আমের ইবনে ফাহিরাকেও নির্দেশ দিয়েছিলেন, সারাদিন দুম্বা চরিয়ে সন্ধ্যা নেমে এলে সেগুলো গুহার পাশ দিয়ে নিয়ে আসবে। আবু বকর (রা.) তার মেয়ে আসমার ওপরও রাতের বেলা তাদের প্রয়োজনীয় খাবার সরবরাহের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
ইবনে হিশাম বলেন, এক আলেম হাসান ইবনে আবিল হাসান সূত্রে আমার কাছে বর্ণনা করেছেন যে, পয়গম্বর (আ.) ও আবু বকর যখন গুহায় পৌঁছলেন, তখন আবু বকর নবীজির আগেই গুহায় প্রবেশ করলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল গুহার ভেতরে যেন কোনো সাপ বা হিংস্র প্রাণী না থাকে। নিজের প্রাণ বাজি রেখে নবীজির পাহারা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারেন।
ইবনে ইসহাক বলেন, পয়গম্বর (সা.) আবু বকর সিদ্দিকসহ তিনদিন গুহায় ছিলেন। কোরাইশরা যখন রাসুলুল্লাহ (সা.) নিরুদ্দেশ হওয়ার কথা বুঝতে পারল তখন ১০০টি উট পুরস্কার ঘোষণা করল। যে ব্যক্তি নবীজিকে ফিরিয়ে আনতে পারবে এবং তাদের হাতে তুলে দিতে পারবে তাকে এ বিশাল পুরস্কার দেয়া হবে। তখন আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকর কোরাইশদের মাঝে থাকতেন এবং ঘুরে ঘুরে লোকদের কাছ থেকে সংবাদ সংগ্রহ করতেন। কোরাইশদের পারস্পরিক সলাপরামর্শ ও নবীজি এবং আবু বকর সম্পর্কে যা কিছু কে কী বলছে তা তিনি শুনতেন। সন্ধ্যায় গুহায় এসে সব খবর তাদের জানাতেন। খাদেম আমের ইবনে ফাহিরা মক্কার লোকদের ছাগল-দুম্বা চরাত, সন্ধ্যা হলে গুহার দিকে যেত এবং আবু বকরের দুম্বাগুলো এগিয়ে দিত। রাসুল (সা.) ও আবু বকর (রা.) দুম্বার দুধ দোহন করতেন। প্রয়োজন হলে একটি দুম্বাও জবাই করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকর যখন খবর পৌঁছিয়ে গুহা থেকে বের হতেন তখন আবদুল্লাহর পায়ের ছাপ মুছে যাওয়ার জন্য আমের ইবনে ফাহিরা তার পেছনে পেছনে দুম্বা হাঁকিয়ে নিয়ে আসত।
মুহাম্মদ ইবনে সাআদ ও যায়দ ইবনে আরকাম আনাস ইবনে মালেক ও মুগিরা ইবনে শো’বা থেকে বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) যখন সে রাতে গুহায় প্রবেশ করেন, সে রাতে আল্লাহর হুকুমে গুহার পথে একটি গাছ জন্মায়। এ গাছ হজরতকে কাফেরদের দৃষ্টির আড়াল করে রাখে। আল্লাহ তায়ালা মাকড়সাকে হুকুম করেন, তখন মাকড়সা গুহার মুখে জাল বিস্তার করে। আর দুইটি বুনো কবুতরকে হুকুম দেন। কবুতররা গুহার মুখে রাতারাতি বাসা বাঁধে। এ সময় কোরাইশ যুবকরা প্রত্যেক পরিবার থেকে তরবারি, লাঠি ও বল্লম নিয়ে নবীজির খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। তারা এক পর্যায়ে নবীজির চল্লিশ গজ কাছে পৌঁছে যায়। তখন কোরাইশের অগ্রবর্তী যুবকটি লক্ষ করল, গুহাটির মুখে কবুতরের বাসায় দুইটি বুনো কবুতর। তা দেখে সে ফিরে গেল। সাথীরা বলল, তুমি গুহার ভেতরে উঁকি দিয়ে কেন দেখলে না? সে বলল, গুহার মুখে আমি দুইটি বুনো কবুতর দেখেছি। তাতে বুঝতে পেরেছি, ভেতরে কেউ নেই। রাসুল (সা.) ভেতর থেকে তাদের আলাপচারিতা শুনতে পেলেন এবং বুঝতে পারলেন যে, আল্লাহ তায়ালা আপন দয়ায় ওই দুই কবুতরের উসিলায় বিপদ দূর করে দিয়েছেন। সন্ধানকারী কোরাইশ যুবকদের মধ্যে একজন বলল, গুহার মুখে যে মাকড়সা জাল বেঁধেছে তা কম করে হলেও মুহাম্মদের জন্মের আগের ঘটনা।
আবু বকর (রা.) বলেন, আমি উঁকি দিয়ে দেখলাম। তখন মুশরিকদের পা দেখতে পেলাম। আমরা তো গুহার মধ্যে ছিলাম। তারা আমাদের মাথার উপরিভাগেই দাঁড়ানো ছিল। বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! তাদের কেউ যদি নিজের পায়ের নিচের দিকে তাকায়, তাহলে তো আমাদের দেখে ফেলবে। হজরত বললেন, হে আবু বকর! সেই দুইজন সম্পর্কে তোমার কী ধারণা, যাদের তৃতীয়জন হলেন আল্লাহ।
বর্ণিত আছে, তারা তিন রাত গুহায় ছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকরও তাদের কাছে থাকতেন। মুহাম্মদ ইবনে সাআদ বলেন, আয়েশা (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) ও আবু বকরকে সর্বোত্তম রসদপত্র দিয়েছিলাম। তারা দুইজনের জন্য গাঁটরির মধ্যে একটি দস্তরখান ঢুকিয়ে দিয়ে আসমা বিনতে আবু বকর ওড়নার একটি আঁচল ছিঁড়ে তা দিয়ে গাঁটরির একটি মুখ বাঁধলেন আরেক টুকরা দিয়ে গাঁটরির অপর প্রান্ত বাঁধলেন আর দুই প্রান্ত জড়ো করে ঝুলির মতো করলেন। এ কারণে হজরত আসমা পরে দুই কাপড়ের টুকরাওয়ালি (যাতুন নেতাকাইন) হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
মুহাম্মদ ইবনে সাআদ আবু বকর (রা.) এর মেয়ে আসমা সূত্রে বর্ণিত, তিনি সনদের ভিত্তিতে বর্ণনা করেন যে, রাসুল (সা.) যখন বেরিয়ে গেলেন এবং তার সঙ্গে আবু বকরও গেলেন, তখন আবু বকর তার সব নগদ অর্থ, যার পরিমাণ হবে পাঁচ কি ছয় হাজার দেরহাম, সঙ্গে করে নিয়ে যান। আমার দাদা আবু কুহাফা বার্ধক্যের কারণে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি আমাদের কাছে এসে বললেন, আল্লাহর কসম, আমার মনে হয়, আবু বকর তোমাদের প্রতি জুলুম করেছে। কেননা, সব নগদ অর্থ সে সঙ্গে নিয়ে গেছে। আমি বললাম, দাদাজান! তিনি তো আমাদের জন্য অনেক টাকা রেখে গেছেন। তিনি ওই রকম কিছু করে যাননি। আমার বাবা ঘরে যে জায়গায় অর্থকড়ি রাখতেন সেখানে আমি কিছু কঙ্কর এনে রাখলাম। তার ওপর একটি কাপড় ঢেকে দিলাম। আমি দাদাকে বললাম, দাদু এই যে টাকা এর ওপর আপনি হাত বুলিয়ে দেখতে পারেন। তিনি তাই করলেন এবং বললেন, ঠিক আছে এখন কোনো চিন্তার কারণ নেই। তোমাদের জন্য এই পরিমাণ টাকা-পয়সা রেখে গেলে তো যথেষ্ট হয়েছে। সে খুব ভালো কাজ করেছে। আসল ব্যাপার হলো, তিনি ঘরে আমাদের জন্য কিছু রেখে যাননি। আমি আমার বৃদ্ধ দাদাকে দুশ্চিন্তামুক্ত করার জন্যই এমনটি করেছি।
এখানেও আমরা লক্ষ্য করছি, হিজরতের সময় সবকিছুর নিখুঁত পরিকল্পনা। দুশমন শিবিরে উত্তেজনা প্রশমনে আত্মগোপন এবং গুহায় খাদ্য সরবরাহের অতি সূক্ষ্ম ব্যবস্থা।
বিশেষ করে শত্রুদের সংবাদ সংগ্রহের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও দূরদর্শী মাধ্যম ব্যবহার। আরবরা দারুণ বিচক্ষণ ছিল। তারা পায়ের চিহ্ন দেখে মানুষের গতিবিধি নিরূপণ করতে পারত। এ কারণে সংবাদদাতা আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকরের পদচিহ্ন মুছে ফেলার অভিনব কৌশল ছিল ছাগল হাটিয়ে তার পায়ের ছাপ মুছে ফেলা। আসলে বান্দা যখন নিজের সাধ্যের সবটুকু ঢেলে দেয়, তার পরের দায়িত্ব আল্লাহপাক নেন। এখানেও বুনো কবুতরের বাসা ও মাকড়সার জাল বিস্তারের অলৌকিক সাহায্য এসে যায়। হজরত আবু বকরের মেয়েরা সফর প্রস্তুতিতে যে ভূমিকা পালন করেন, তা আল্লাহর পথে পরিবারের সদস্যদের আন্তরিক সহযোগিতার উজ্জ্বল নমুনা। যারা দ্বীনের পথে কাজ করেন তারা এ ধরনের সূক্ষ্ম কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেন কিনা বা শত্রুর গতিবিধির ওপর কতখানি নজরদারি আছে তা প্রত্যেকের চিন্তা করে দেখা দরকার।