হাশরের ময়দানে আমলের হিসাব-নিকাশ

একাত্তর লাইভ ডেস্ক:
দুনিয়া হলো পরকালের শস্যক্ষেত্র। আমলের বীজ বপন এবং চাষাবাদের জায়গা। দুনিয়ায় যে যেমন আমলের বীজ বপন করবে, যেমন চারা রোপণ করবে, যেমন সময়-শ্রম দিয়ে আমলের চাষাবাদ করবে, পরকালে সে তেমনই ফল ও প্রতিদান ভোগ করবেÑ এটা আমাদের বিশ্বাসের সংস্কৃতি। আর মৃত্যুর পর হাশরের ময়দান কায়েম হওয়া একটি চিরন্তন সত্য।
যেমন আমল তেমন ফল : হাশরের ময়দানে বান্দাদের অবশ্যই আল্লাহ তায়ালার সামনে এসে দাঁড়াতে হবে। আল্লাহ সেদিন প্রত্যেকের কৃত আমল সম্পর্কে জানিয়ে দেবেন। এরপর তাদের আমল অনুপাতে প্রতিদান দেবেন। প্রতিটি নেক কাজের বিনিময়ে ১০ থেকে ৭০০ গুণ প্রতিদান দেবেন, বরং কাউকে কাউকে আরও বাড়িয়েও দেবেন। আর বদ কাজের বিনিময়ে সমপরিমাণই প্রতিদান দেবেন। এর কমও দেবেন না বাড়িয়েও দেবেন না।
প্রত্যেককেই তার আমলনামা দেয়া হবে। সে জীবনে ভালো-মন্দ যা কিছুই করেছে, তাতে সব লেখা আছে। নেককার ও ভাগ্যবানদের আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে, আর বদকার ও দুর্ভাগাদের আমলনামা দেয়া হবে বাঁ হাতে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যার আমলনামা বাঁ হাতে দেয়া হবে, সে বলবে হায়! আমাকে যদি আমার আমলনামা না দেয়া হতো। আমি যদি না জানতাম আমার হিসাব। হায়! আমার মৃত্যুই যদি শেষ হতো।’ (সূরা হাক্কাহ : ২৫-২৭)।
আমলনামার হিসাবে বান্দাদের একদল যাবে জান্নাতে অপর দল জাহান্নামে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এমনিভাবে আমি আপনার প্রতি আরবি ভাষায় কোরআন নাজিল করেছি, যাতে আপনি মক্কা ও এর আশপাশের লোকদের সতর্ক করেন এবং সতর্ক করেন হাশরের দিন সম্পর্কে, যাতে কোনো সন্দেহ নেই। একদল যাবে জান্নাতে এবং অপর একদল জাহান্নামে।’ (সূরা শূরা : ৭)। আল্লাহ আর বলেন, ‘রাজত্ব সেদিন আল্লাহরই, তিনিই তাদের বিচার করবেন।’
অতএব যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে, তারা নেয়ামতে ভরা জান্নাতে থাকবে। আর যারা কুফরি করে এবং আমার আয়াতগুলোকে মিথ্যা বলে, তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর শাস্তি।’ (সূরা হজ : ৫৬-৫৭)।
হিসাব-নিকাশের ধরন : কেয়ামতের দিন যাদের হিসাব নেয়া হবে তারা মূলত দুই শ্রেণীতে বিভক্ত হবে। এক শ্রেণী হলো, যাদের হিসাব খুব সহজ হবে। সেটি শুধু আমলনামা প্রদর্শন করার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
মোমিনদের জননী হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন যারই হিসাব নেয়া হবে সে ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি জানতে চাইলাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ, আল্লাহ তায়ালা কি বলেননি, যার আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে তার হিসাব সহজ করে নেয়া হবে! রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, এটি হচ্ছে শুধু প্রদর্শনের ক্ষেত্রে। আর কেয়ামতের দিন যার হিসাব জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে নেয়া হবে, তাকে অবশ্যই শাস্তি দেয়া হবে।’ (বোখারি : ৬৫৩৭, মুসলিম : ২৮৭৬)।
অপর শ্রেণী হলো, যাদের হিসাব খুব কঠিন করে নেয়া হবে। ছোটবড় প্রত্যেক বিষয়েই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। যদি সত্যি বলে তাহলে খুবই ভালো। আর যদি মিথ্যা বলে অথবা গোপন করার চেষ্টা করে তাহলে তাদের মুখে সিলমোহর এঁটে দেয়া হবে, তখন তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কথা বলতে থাকবে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আজ আমি তাদের মুখে মোহর এঁটে দেব, তাদের হাত আমার সঙ্গে কথা বলবে এবং তাদের পা তাদের কৃতকর্মের সাক্ষ্য দেবে।’ (সূরা ইয়াসিন : ৬৫)।
যাদের হিসাব নেয়া হবে : উম্মতে মুহাম্মদিয়ার ৭০ হাজার লোক বিনা হিসাব ও বিনা আজাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। এটা রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সম্মান ও বৈশিষ্ট্যের কারণে হবে। এছাড়া কেয়ামত দিবসে ব্যাপকহারে সবার হিসাবই নেয়া হবে। কাফেরদের হিসাবের আওতায় আনা হবে।
তিরস্কার ও হেয় করার উদ্দেশ্যে তাদের সামনে তাদের কৃত আমল পেশ করা হবে। আজাব ভোগ করার দিক থেকে তারা বিভিন্ন শ্রেণিভুক্ত হবে।
যাদের পাপ ও কুকর্ম বেশি তাদের শাস্তি কঠিন হবে। আর যাদের কিছু সৎকর্মও রয়েছে, তাদের শাস্তি তুলনামূলক কম হবে। তবে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।
কেয়ামতের দিন উম্মতদের মধ্যে সর্বপ্রথম উম্মতে মুহাম্মদিয়ার হিসাব নেয়া হবে। আর মুসলমানদের আমলের মধ্যে সর্বপ্রথম নামাজের হিসাব নেয়া হবে।
নামাজ যদি সঠিক প্রমাণিত হয়, তাহলে তার সব আমলই সঠিক বের হয়ে আসবে। আর নামাজের মধ্যে সমস্যা দেখা দিলে সব আমলেই সমস্যা দেখা দেবে। আর মানুষের হকের মধ্যে সর্বপ্রথম রক্তপাতের হিসাব নেয়া হবে।
যেসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে : হাশরের ময়দানের মূল প্রশ্ন তো হবে, ‘তোমার রব কে? তোমার নবী কে? এবং তোমার দ্বীন কী?’ এ প্রশ্ন তিনটিকে ঘিরে আরও অনেক প্রশ্ন উৎসারিত ও উত্থাপিত হবে।
এর কিছু এমন ১. আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে শিরক করা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে। আল্লাহ বলেন, ‘যেদিন আল্লাহ তাদের ডাক দিয়ে বলবেন, তোমরা যাদের আমার শরিক দাবি করতে তারা কোথায়?’ (সূরা কাসাস : ৬২)। ২. নবী-রাসুলদের প্রতি ঈমান না আনা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তাদের ডেকে বলবেন, তোমরা রাসুলদের কী জবাব দিয়েছিলে?’ (সূরা কাসাস : ৬৫)।
আল্লাহ আরও বলেন, ‘অতএব, আমি অবশ্যই তাদের জিজ্ঞেস করব যাদের কাছে রাসুল প্রেরিত হয়েছিল এবং আমি অবশ্যই জিজ্ঞেস করব রাসুলদের। এরপর আমি স্বজ্ঞানে তাদের কাছে অবস্থা বর্ণনা করব। বস্তুত আমি তো অনুপস্থিত ছিলাম না।’ (সূরা আরাফ : ৬-৭)। ৩. আমাদের প্রতিটি কাজকর্ম সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে। আল্লাহ বলেন, ‘অতএব, আপনার পালনকর্তার কসম, আমি অবশ্যই ওদের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করব ওদের কাজকর্ম সম্পর্কে।’ (সূরা হিজর : ৯২-৯৩)। ৪. আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ ও নেয়ামতরাজি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে। আল্লাহ বলেন, ‘এরপর অবশ্যই সেদিন তোমরা নেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সূরা তাকাসুর : ৮)। ৫. ওয়াদা-অঙ্গীকার সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে। আল্লাহ বলেন, ‘আর অঙ্গীকার পূরণ করো। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ (সূরা ইসরা : ৩৪)।
৬. শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে প্রশ্ন করা হবে। আল্লাহ বলেন, ‘যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই তার পেছনে পড়ো না। নিশ্চয়ই কান, চোখ ও অন্তঃকরণ এদের প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সূরা ইসরা : ৩৬)।
৭. সাহাবি আবু বারজাহ আসলামি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন প্রত্যেক ব্যক্তির দুই পা নিম্নোক্ত বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হওয়ার আগ পর্যন্ত নিজ জায়গায় স্থির থাকবে। তার বয়স সম্পর্কে, কী কাজে সে সেটি নিঃশেষ করেছে। জ্ঞান সম্পর্কে, এর মাধ্যমে সে কী করেছে। সম্পদ সম্পর্কে, কোথা থেকে (কী উপায়ে) সম্পদ উপার্জন করেছে আর কোন কাজে ব্যয় করেছে। আর তার শরীর সম্পর্কে, কী কাজে সেটি জীর্ণ ও ক্ষয় করেছে।’ (তিরমিজি : ২৪১৭, দারেমি : ৫৪৩)।
কাফেরদের ভালো কাজের বিধান : কোরআন ও হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী, অবিশ্বাসী কাফের ও মোনাফেকদের কোনো ধরনের ইবাদত ও নেক আমল কবুল করা হয় না। কারণ ইবাদত কবুল হওয়ার প্রধান শর্ত মূল্যবান ঈমান।
তাদের নেক আমলগুলো এমন ছাইভস্মের মতো, ধূলিঝড়ের দিন যার ওপর দিয়ে প্রবল বাতাস বয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা স্বীয় পালনকর্তার সত্তায় অবিশ্বাসী, তাদের অবস্থা হলো, তাদের নেক আমলগুলো ছাইভস্মের মতো, যার ওপর দিয়ে প্রবল বাতাস বয়ে যায় ধূলিঝড়ের দিন। তাদের উপার্জনের কোনো অংশই তাদের করতলগত হবে না। এটাই দূরবর্তী পথভ্রষ্টতা।’ (সূরা ইবরাহিম : ১৮)।
কেয়ামতের দিন সব মানুষের সামনে তাদের সম্পর্কে ঘোষণা দেয়া হবে, তারাই সেসব লোক যারা স্বীয় প্রতিপালকের ওপর মিথ্যা আরোপ করেছিল।
সাহাবি হজরত আনাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা কোনো মোমিন বান্দার ওপরই একটি ছোট্ট নেক আমলের ক্ষেত্রেও কোনোরূপ অন্যায় করেন না। ওই নেক আমলের বিনিময়ে দুনিয়ায় (রিজিক) দান করেন আর পরকালে উপযুক্ত প্রতিদান দেন। আর কাফেররা কৃত নেক আমলের বিনিময়ে দুনিয়ায় জীবনোপকরণ লাভ করে। এক পর্যায়ে যখন সে আখেরাতের দিকে যাত্রা করে, তখন তার আমলনামায় আর কোনো আমলই থাকে না যে, তাকে প্রতিদান দেয়া হবে।’ (মুসলিম : ২৮০৮)।
তবে কাফের-মুশরিকদের অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুরা মোমিন-মুসলমানদের শিশুদের মতো জান্নাতে যাবে। তারা বয়স্কদের মতো আদি পিতা আদম (আ.) এর আকৃতিতে জান্নাতে প্রবেশ করবে। কারণ তাদের আমলনামায় কোনো পাপ থাকবে না।