আন্তর্জাতিক ডেস্ক : সংযুক্ত আরব আমিরাতের পর এবার মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরব বিদেশিদের নাগরিকত্ব দিতে যাচ্ছে।
সৌদি গেজেটের খবরে বলা হয়েছে, আইন, চিকিৎসা, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, খেলাধুলা ও প্রযুক্তিবিদ্যায় বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন ও মেধাবীদের নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। গত ১১ নভেম্বর এক রাজকীয় ফরমানে এই অনুমোদন দেন বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আজিজ।
প্রথম দিনেই নাগরিকত্ব লাভ করেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মুখতার আলম শিকদার। তিনি মক্কায় কাবাঘরের গিলাফ প্রস্ততকারক প্রতিষ্ঠানে দুই দশক ধরে প্রধান ক্যালিগ্রাফার হিসেবে কাজ করছেন।
সৌদি আরব তেল নির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ‘ভিশন-২০৩০’ প্রণয়ন করেছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে দক্ষ ও চৌকস পেশাজীবীদের আকৃষ্ট করতে চায় দেশটি। কর্তৃপক্ষের আশা নাগরিকত্ব লাভকারী দক্ষ পেশাজীবীরা সৌদি আরবের বিভিন্ন উন্নয়নে অবদান রাখবেন। তবে সীমিত সংখ্যক পেশাজীবীদেরই এই সুযোগ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে সৌদি গেজেট।
এর আগে ২০১৯ সালে দেশটির শুরা কাউন্সিল প্রবাসীদের জন্য রেসিডেন্ট পারমিট দেওয়ার বিধান রেখে একটি আইনের খসড়া অনুমোদন দেয়। তারা মূলত: বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগাতে এবং সৌদি আরবে বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যবসায়ীদের জন্য এই সুবিধা চালু করে। ‘প্রিভিলেজড ইকামা’ নামে এই প্রকল্পটি সৌদি গ্রিন কার্ড নামেও পরিচিতি পেয়েছে। তখন বলা হয়েছিল দক্ষ পেশাজীবীদের জন্য দেশটির নাগরিকত্ব আইন শিথিল করা হবে। এর দুই বছরের মাথায় এবার বিদেশিদের নাগরিকত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল দেশটি।
২০১৯ সালে যখন সৌদি গ্রিন কার্ড চালু হয়, তখন রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম বলেছিলেন, সৌদি আরবের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক নামী-দামি বাংলাদেশি শিক্ষক আছেন। দেশটিতে অনেক নামকরা চিকিৎসক ও প্রকৌশলী বাংলাদেশি নাগরিক। ব্যবসা করেও সুনাম কুড়িয়েছেন অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি, যারা ‘সবাই চাইলে এ সুযোগ নিতে পারবেন।’
তার ভাষায়, ‘যাদের ভালো মূলধন আছে অথবা যারা বড় ধরনের বিনিয়োগ করতে পারবেন, তারা চাইলে নাগরিকত্ব সুবিধা নিয়ে পুঁজি বিনিয়োগের সুযোগ পাবেন।’ তবে সৌদি আরবে নাগরিকত্ব লাভের বিষয়টি কিছুটা জটিল। মূলত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশক্রমে এই নাগরিকত্বের অনুমোদন দেবে রাজতান্ত্রিক সরকার। পদ্ধতি জটিল হলেও অসম্ভব নয়, এমনকি দেশটিতে এর আগে একটি রোবটকেও নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছিল। নারীদেহের আদলে হংকংয়ে তৈরি রোবট সোফিয়াকে সৌদি আরব ২০১৭ নাগরিকত্ব দেয়, তখন এ নিয়ে বেশ হৈচৈ হয়েছিল।
নিয়ম ও শর্ত
আবেদনকারী বা তার আইনি প্রতিনিধি সৌদি আরবের সিভিল অ্যাফেয়ার্স বিভাগ বা দেশটির প্রতিনিধির কাছে আবেদন করতে পারবেন। তিন সদস্যের একটি কমিটি যেসব তথ্য যাচাই করবে:
আবেদনকারীকে অবশ্যই বৈধ উপায়ে দেশটিতে প্রবেশ করতে হবে এবং একটি বৈধ পাসপোর্ট ধারণ করতে হবে যার মাধ্যমে তিনি কোনও বিধিনিষেধ বা শর্ত ছাড়াই তার নিজ দেশে ফিরতে পারবেন।
নিজ খরচে দেশটির বসবাসের অনুমতি বা রেসিডেন্সি পারমিটের আওতায় অন্তত ১০ বছর সৌদি আরবে থাকতে হবে। দেশের প্রয়োজনীয় একটি পেশায় কাজ করতে হবে।
আবেদনকারীর তথ্য দেওয়ার পর কমিটি তিনটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে আবেদনটি মূল্যায়ন করবেন। এখানে মোট ৩৩ পয়েন্ট ভাগ করা আছে। আবেদনকারী অন্তত ১০ বছর সৌদিতে অবস্থান করলে ১০ পয়েন্ট স্কোর হবে। আবেদনকারী যদি দেশটির প্রয়োজন সাপেক্ষে বিজ্ঞানের কোনও শাখায় পারদর্শী হন তাহলে তিনি এখান থেকে সর্বোচ্চ ১৩ পয়েন্ট পেতে পারেন। যেকোনও একটি অপশন বেছে নেওয়া যাবে। মেডিসিন বা ইঞ্জিনিয়ারিং পেশায় ডক্টরেট ডিগ্রি থাকলে স্কোর হবে ১৩ পয়েন্ট। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় ডক্টরেট ডিগ্রি থাকলে ১০ পয়েন্ট। মাস্টার্স ডিগ্রি আট পয়েন্ট। ব্যাচেলর ডিগ্রি পাঁচ পয়েন্ট।
পারিবারিক বন্ধন অর্থাৎ আবেদনকারীর সৌদিতে কোনও আত্মীয় রয়েছেন কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে। সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১০ পয়েন্ট পাওয়া যাবে।
বাবা সৌদি নাগরিক হলে তিন পয়েন্ট। মা-বাবা উভয়েই সৌদি নাগরিক হলে তিন পয়েন্ট। শুধু মা সৌদি নাগরিক হলে দুই পয়েন্ট। যদি স্ত্রী ও শ্বশুর সৌদি নাগরিক হয় তাহলে তিন পয়েন্ট। যদি শুধু স্ত্রী সৌদি নাগরিক হন তাহলে এক পয়েন্ট। আবেদনকারীর দুই জনের বেশি সৌদি সন্তান ও ভাই থাকলে তাহলে দুই পয়েন্ট বরাদ্দ হয়। তবে দুইয়ের বেশি না থাকলে এক পয়েন্ট বরাদ্দ হয়।
আবেদনকারী যদি ন্যূনতম স্কোর হিসেবে ২৩ পয়েন্ট পান, তাহলে কমিটি আবেদনটি আরও পর্যালোচনার সুপারিশ করবে। এর মধ্যে আবেদন জমা দেওয়ার বাকি প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করা হয় এবং চূড়ান্ত সুপারিশ জারির জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জমা দেওয়া হয়। এরপর প্রয়োজনীয় সনদ, স্বাস্থ্য রিপোর্ট, সম্পদের হিসাব, ধর্ম/রাজনৈতিক মতাদর্শের ব্যাখ্যাসহ এই আবেদনপত্র জমা দিতে হবে।
বৈবাহিক ও জন্মসূত্রে
কোনও ব্যক্তি সৌদি নাগরিকত্ব পাওয়ার পর এক বছরের মধ্যে তার স্ত্রীকেও নাগরিকত্ব নিতে হবে। এরপরে আর আবেদন গ্রহণ করা হবে না। তবে ওই ব্যক্তি চাইলে স্ত্রীর নাগরিকত্বের জন্য পরে আলাদা দরখাস্ত করতে পারবেন। এক্ষেত্রে তাদের সন্তান যদি সৌদিতে বসবাস করেন তাহলে ওই সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার এক বছরের মধ্যেই তাকে নাগরিকত্বের আবেদন জানাতে হবে। তার আগ পর্যন্ত তিনি সৌদি আরবে থাকার সুযোগ পাবেন। তবে কোন বিদেশি নারী যদি সৌদি পুরুষকে বিয়ে করেন তাহলে তিনি তার স্বামীর দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পারবেন।
অন্যদিকে সৌদি নারী কোনও ভিনদেশি পুরুষকে বিয়ে করলে তিনি চাইলে তার সৌদি নাগরিকত্ব নিয়েই থাকতে পারবেন। তিনি যদি তার স্বামীর দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন তাহলে স্বামীর মৃত্যুর পর বা বিচ্ছেদের পর তিনি চাইলে তার সৌদি নাগরিকত্ব ফিরে পেতে পারেন।
এই প্রক্রিয়ায় কেউ যদি ভুয়া কাগজপত্র বা মিথ্যা তথ্যের আশ্রয় নেয় তাহলে তাদের সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড এবং এক হাজার রিয়াল জরিমানার বিধান রয়েছে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা (ছবি: বিবিসি)