অনলাইন ডেস্ক : সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা, দিন—যেটাকেই একক ধরা হোক না কেন, সময় এগিয়ে যায় তার নিজস্ব পরিক্রমায়। কাল থেকে মহাকাল রচনা করে পৃথিবী ঘুরছে তার কক্ষপথে। ব্ল্যাকহোল, বিগব্যাঙ, গ্যালাক্সি যেখানেই এই চলার শেষ হোক না কেন, মনের ক্যাচিগেট দিয়ে ঢোকে পড়া যাতনাময় অনুভূতিগুলো মানব হৃদয়কে বেদনাহত করে প্রতিনিয়ত।
ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো উল্টে যায়, বছরের অষ্টম মাস আগস্ট এসে ভাবনার দরজায় টোকা মারে। হাতুড়িপেটার মতো আঘাতগুলো মস্তিষ্কের নিউরন, ভাবনা ও চেতনাকে অবশ করে দিতে চায়, এই ভেবে যে, ১৫ আগস্ট জাতির পিতার শাহাদত দিবস বলে।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার স্থপতি, জুলিও কুরি-শান্তি পদকপ্রাপ্ত বিশ্বনেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে উনবিংশ শতাব্দীর আরেক মীরজাফরের বেইমানিতে। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫, ৮ শাবান ১৩৯৫ আরবি, বাংলা ১৩৮২, ২৯ শ্রাবণ, শুক্রবার বাঙালি জাতির ললাটে কলঙ্কের ছাপ, বিশ্বাসঘাতকতার বেদিমূলের ভিত্তি গড়ে, যা অনুশোচনা আর হৃদয়পীড়ায় ব্যথিত করে সব বাঙালির হৃদয়কে।
যার জন্য আজকের এই বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা আর বাতাসে পত পত করে উড়া লাল-সবুজের পতাকা, তাকে নির্মমভাবে হত্যা করল কয়েকজন বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা; যাকে যুদ্ধের সময় রাওয়ালপিন্ডি জেলে রেখে বারবার হত্যা করার জন্য চেষ্টা করেও পারেনি পাকিস্তানি সেনারা।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর যে আশায় পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান ভাগ হয়, তার সুফল পায়নি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ। বৈষম্য, নিপীড়ন, অর্থনৈতিক, সামাজিক সর্বস্তরে নিষ্পেষিত করার মাধ্যমে অতিষ্ঠ হয়ে যায় পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার যোগ্য নেতৃত্ব, ব্যক্তিত্ব সুদূরপ্রসারী চিন্তা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান দিয়ে দেশের জনগণকে স্বাধীনতাকামী মনোভাব গঠনে উদ্বুদ্ধ করেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট, ১৯৬২ সালের স্বাধিকার আন্দোলন, ১৯৬৪ সালে শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ৬ দফা, ১৯৭০ সালের নির্বাচন, সবকিছুতেই নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার বক্তৃতা, ব্যক্তিত্ব, সুদৃঢ় নেতৃত্বে অনুপ্রাণিত বাঙালিকে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতার ডাক দেন। ১৯ মিনিটের সেদিনের বক্তৃতা আজ বিশ্ব ঐতিহ্য দলিলে সেরা বক্তৃতা হিসেবে স্থান পেয়েছে।
৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ স্বাধীনতার স্বাদ পায় বাঙালি জাতি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের কঠিন দায়িত্ব কাঁধে তোলে নিলেন বঙ্গবন্ধু। তার কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও পাহাড়সম ব্যক্তিত্ব এবং নেতৃত্বের কারণে ২২১টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির কূটকৌশল, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি, স্বার্থ, সবশক্তি এক হয়ে জন্ম দেয় ১৫ আগস্টের। ইতিহাসের পাতায় স্থান পায় এক কলঙ্কিত অধ্যায়ের।
কালো পিচঢালা রাজপথ মাড়িয়ে ছুটে চলা ট্যাংক, সাঁজোয়া বহর, নীরব হয়ে গিয়েছিল রাত জাগা পাখিরা। ওরা ভুলে গিয়েছিল রাতের প্রহর জানাতে। দূর আকাশের কয়েকটা তারা ও ভেসে যাওয়া মেঘেরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ দেখে।
মেজর রশিদের নেতৃত্বে ৩২ নম্বর বাড়িটি ঘিরে রেখে পুরো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় সেনারা। পাঁচ-ছয়জন আর্মি, কেউ কালো পোশাকধারী, কেউ খাকি পোশাকে। এগিয়ে যায় ওরা ভেতরে। বাইরে কোলাহল শুনে বেরিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধুর জ্যৈষ্ঠপুত্র শেখ কামাল। শেখ কামালকে সামনে দেখে সেনারা বলল, ‘হ্যান্ডস আপ’।
শেখ কামাল বললেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের ছেলে, শেখ কামাল।’ কথা শেষ হতেই ব্রাশফায়ারের শব্দে কেঁপে উঠে পুরো বাড়ি। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে মুখ থুবড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন শেখ কামাল। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রহাতে ছুটে যায় মেজর নূর, সিঁড়ি বেয়ে ওপরে। বঙ্গবন্ধু এগিয়ে এসে সিঁড়িতে দাঁড়ান। স্বভাবসুলভ কণ্ঠে আঙুল উঁচিয়ে জানতে চান ‘কোথায় নিয়ে যেতে চাস তোরা আমাকে? কী চাস তোরা?’ উত্তরে আসে তপ্ত বুলেট। ঝাঁঝরা হয়ে যায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর দেহ। সিঁড়িতেই নিথর হয়ে পড়ে থাকেন ফিদেল ক্যাস্ট্রোর হিমালয়।
দূর থেকে পিশাচের হাসিটা হেসেছিলেন সেদিন মেজর মহিউদ্দিন। ওপরে দরজার সামনেই পড়ে থাকে বেগম মুজিব, বঙ্গমাতার রক্তাক্ত নিথর দেহ।
সিঁড়ির সঙ্গেই ডানদিকে শেখ জামালের ঘর। ভেতরে চারকোনা প্যাসেজ, একদিকে শেখ রেহানার ঘর, অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু ও পাশেই শেখ হাসিনার ঘর। আর তিন তলায় শেখ কামালের। বিভীষিকাময় সেই রাতে গুলির শব্দে ভীতসন্ত্রস্ত সবাই নিজ রুম থেকে দৌড়ে বঙ্গবন্ধুর ঘরে একত্রিত হয়েছিলেন এবং সেখানেই সবাই নিহত হন।
বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে বুলেটের চিহ্ন, প্লাস্টার ক্ষয়ে সরে গেছে। সে রাতে সর্বশেষে পিশাচরা হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠপুত্র ১০ বছরের শেখ রাসেলকে। ভয়ার্ত রাসেল কান্না করেছিল আর বলেছিল, ‘আমি মায়ের কাছে যাব’ বলে। একজন সেনা অবুঝ শিশু রাসেলকে বলল, ‘চল তোকে তোর মায়ের কাছে নিয়ে যাব।’ নিষ্পাপ রাসেল সেনাটির কথায় বিশ্বাস করে ওপরে যায়। পরক্ষণই গুলির শব্দ। কচি দেহটা ঝাঁঝরা, ক্ষতবিক্ষিত হয়ে লুটিয়ে পড়ে।
সকাল হতেই একটা কালো গ্লাসের গাড়ি এসে থামে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে। গাড়ি থেকে প্রশ্ন করা হয়, ‘গাইজ, হোয়াট দ্য নিউজ? অল ফিনিস?’ সমস্বরে সেনারা জানায়, ‘ইয়েস স্যার, অল আর ফিনিসড’।
সেদিন থেকে জাতির ললাটে ঝুলে আছে পিতার রক্তঋণ।