নিজস্ব প্রতিবেদক:
কেন্দ্রভিত্তিক ভোটের অতীত রেকর্ড আর জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী-সাখাওয়াত হোসেন নিজেদের এগিয়ে রাখলেও ভোটের হিসাব জটিলই দেখছেন ভোটাররা। আগামী ২২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হওয়ায় এ জটিলতা আরও বেড়ে গেছে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের বন্দর থানা ও সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা গতকাল শনিবার ঘুরে জানা যায়, দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় এবার প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা, উন্নয়ন কর্মকান্ড, জনসেবা মুখ্য হয়ে উঠছে না। সাধারণ মানুষের মধ্যে উন্নয়ন অগ্রগতি মাপকাঠির নিয়ামক হলেও সচেতন ও দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে বিস্তর বিভাজন সৃষ্টি করে রেখেছে। যেটি ২০১১ সালের নাসিক নির্বাচনে ছিল না বললেই চলে। ফলে বিজয়ের হিসাব আওয়ামী লীগ-বিএনপি সহজে কষলেও সাধারণ ভোটাররা তত সহজ বলে মনে করছেন না।
এদিকে নাসিক নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হওয়ায় স্বস্তি-অস্বস্তির দোলাচলে ভোটাররা। নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে এসেছেও পছন্দের প্রার্থী চূড়ান্ত করতে পারছেন না তারা। নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানার ২১নং ওয়ার্ডের ভোটার মঈনুদ্দিন। ২০১১ সালের নাসিক নির্বাচনে আইভীর দোয়াত কলম মার্কায় ভোট দিয়েছিলেন তিনি। নির্দলীয় হওয়ায় তার পক্ষে প্রচারও চালান তিনি। কিন্তু এবার সরি বলছেন! কারণ উল্লেখ করে মঈনুদ্দিন বলেন, ভাই এটি আদর্শিক দ্বন্দ্ব।
এদিকে নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের ভেতরে নানা কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে। নগরের প্রত্যেক এলাকায় এখন আলোচনার প্রধান উপাত্ত নির্বাচন। আইভী নাকি সাখাওয়াত এ নিয়ে চলছে জোর আলোচনা। পক্ষে-বিপক্ষে। কেউ বলছেন, বেশিরভাগই শুনছেন; আবার কেউ মুচকিও হাসছেন।
বন্দরের ঘাট শ্রমিকদের জটলায়ও আলোচনা নির্বাচন। একটি জটলার মূল আলোচক ঘাটশ্রমিক পায়েল বলেন, আইভী অনেক জনপ্রিয়। তিনি অনেক উন্নয়ন করেছেন। দলমত সবার কাছেই প্রিয়। কিন্তু দলীয় প্রার্থী হওয়ায় এবার জটিলতা দেখা দিয়েছে। গতবার যারা ভোট দিয়েছেন, এবার দলের প্রার্থী হওয়ায় অনেকেই ভোট নাও দিতে পারেন। জটলায় থাকা মাঝি আরমান বলেন, নৌকাই কাল হতে পারে আইভীর। কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, নৌকার পক্ষের স্থানীয় শক্তি এখনো মাঠে নেই। নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ ভাইয়ের সঙ্গে। ভোট এসেই গেল কিন্তু তারা কই? গতবার এই সময়ে তো তাদের তর্জন-গর্জনে অস্থির ছিল বন্দর।
বিএনপির প্রার্থী সাখাওয়াতকে খুব বেশি জনপ্রিয় ভাবছেন না স্থানীয় ভোটাররা। বন্দর থানার ১৯, ২০, ২১ ও ২২নং ওয়ার্ডের ১০ প্রবীণ, ২০-২৫ জন নবীন, ৫০-এর অধিক শ্রমিক, ১০ জন স্থানীয় রাজনীতিবিদসহ শতাধিক সাধারণ ভোটারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জনপ্রিয়তার দিক থেকে প্রার্থী হিসেবে আইভী এগিয়ে আছেন। এ হিসাবে আমরা হয়তো এখনই বলে দিতে পারি তিনি জয়ী হবেন। কিন্তু গতবারের হিসাব এবার মিলবে না। রাজনীতিবিদরা এখন রাজনীতিক হিসাব কষছেন। যারা গেল নির্বাচনে দলসমর্থিত প্রার্থী তৈমূর-শামীমকে না; সর্বদলীয় ও নাগরিক সমাজের প্রার্থী হিসেবেই আইভীকে ভোট দিয়ে জিতিয়েছিলেন। এবার আইভী দলীয় প্রার্থী। আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে লড়ছেন। তাহলে এবার কেন ভিন্ন দলের একজন নেতা, একজন কর্মী তাকে ভোট দেবেন? এবার তো দলীয় বিবেচনায় তিনি ভোট পাবেন।
নারায়ণগঞ্জ সদর ও বন্দর থানার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ভোটারদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, এখন পর্যন্ত ভোটের যে আবহাওয়া, তাতে রিজার্ভ বলে কারো কোনো ভোট বা কেন্দ্র থাকছে না। গতবারের মতো এবার অন্ধভক্ত ভোটার সংখ্যাও নেই। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় ভোটারদের মধ্যেও একটি দলবাজ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তবে সেখানে সাধারণ ভোটারদের সম্পৃক্ততা অতি অল্প।
নির্বাচন নিয়ে অনেক ভোটার উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এবার কি ভোট দিতে পারব? কারণ উল্লেখ করে তারা বলেন, গত নির্বাচনে একটি উৎসবমুখর পরিবেশ ছিল। এবার সেটি গুমোট আকার ধারণ করেছে। গতবার নির্বাচনে সাধারণ মানুষের একটি সম্পৃক্ততা লক্ষ্য করা গেছে। এবার নেই। ভোটাররা শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে দেখছেন। ভোটের কথা বলছেন না, শুধু শুনছেন এটি কীসের আলামত?
নারায়ণগঞ্জ সদরের ১৫নং ওয়ার্ডের ধর্মতলা ও ১২নং ওয়ার্ডের খানপুর পৌর মার্কেটে বেশকিছু ভোটারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে আইভী এগিয়ে থাকলেও এবার ট্রাম্প হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেন সাখাওয়াত। স্থানীয় আওয়ামী লীগে দলীয় কোন্দল, নৌকার প্রার্থী হওয়ায় জামায়াত-হেফাজতের ভোট, জেলা পরিষদের অভিমানে জাতীয় পার্টির ভোট হাতছাড়া হতে পারে আইভীর। এ ছাড়া গতবার বিএনপির নির্বাচন-বর্জন ও সেসব ভোট আইভীর বিজয় নিশ্চিত করলেও এবার নিজ দলের একটি অংশের ভোট গাঁটছাড়া হতে পারে। সব মিলে সহজে জেতার হিসাব অতিসহজে মেলাতে পারছেন না আইভীভক্তরা।
একই অবস্থা বিএনপির প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেনেরও। সাখাওয়াত নারায়ণগঞ্জ সাত খুন মামলার প্রধান আইনজীবী। এন্টি সরকার মনোভাবাপন্ন ভোটারের প্রার্থীও তিনি। শুধু তাই নয়, নারায়ণগঞ্জে বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের দ্বারা হয়রানির শিকার, হামলা-মামলার শিকার ও আর্থিক ক্ষতির শিকার জনগণের ভোটও টানার চেষ্টা করছেন তিনি। কিন্তু সাধারণ ভোটাররা এখন অনেক সচেতন। নগরের কাজ কাকে দিয়ে হবে, সে হিসাবটিও বিশ্লেষণ করছেন তারা। তা ছাড়া অতীতের কৃতকর্ম, রাজনৈতিক হিসাব মিলিয়ে ভোট দেবেন সাধারণ ভোটাররা। এ হিসেবে এখন কে এগিয়ে থাকবেন, কে হবেন নারায়ণগঞ্জের নগরপিতা, তা জানতে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।