নরসিংদীতে কলেজ ছাত্রকে অপহরণ করে হত্যা,আদালতে স্বীকারোক্তি মহিলা খুনীর

আসাদুল হক পলাশ, নরসিংদী থেকে : অপহরণের পর মাহফুজ সরকার নামে এক কলেজ ছাত্রকে বীভৎসভাবে খুন করার এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা ধরা পড়ে গেছে। রাবেয়া ইসলাম রাবু নামে এক খুনী মহিলা ও তার আত্মীয়রা মাহফুজকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে ৬/৭ টুকরা করে ট্রলি ব্যাগে ভর্তি করে মেঘনার পানিতে ফেলে দিয়েছে।নিখোঁজের ৪ দিন পর গত মঙ্গলবার খুনী রাবেয়া আদালতে ১৬৪ ধারার জবানবন্দীতে এই বীভৎস খুনের কথা স্বীকার করেছে। রাবেয়ার স্বীকারোক্তির পথ ধরে নরসিংদী থানা পুলিশ মাহফুজকে হত্যার কাজে ব্যবহৃত রক্তমাখা ছুরি ও তার ব্যবহৃত কাপড় চোপড় উদ্ধার করেছে।

নিহত মাহফুজের বড় ভাই এড. মোস্তফা সরকার রাসেল জানিয়েছেন, নিহত মাহফুজ সরকার নরসিংদী সরকারী কলেজের বি.এ দ্বিতীয় বর্ষের নিয়মিত ছাত্র। গত ২৬ মে শুক্রবার বিকেলে মাহফুজ বাড়ী থেকে প্রতিদিনের মত বেরিয়ে যায়। এরপর সেদিন রাতে আর সে বাড়ী ফিরেনি। তার পিতা আ: মান্নান সরকার ও বড় ভাই রাসেলসহ অন্যান্য আত্মীয়রা তাকে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুজি করে না পেয়ে ২৭ মে নরসিংদী সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করে। পরদিন মাহফুজের মোবাইল থেকে একটি কল আসে তার বড় ভাই এড. রাসেলের মোবাইল ফোনে। এই ফোন নাম্বার থেকে রাসেলকে জানানো হয় যে, মাহফুজ বর্তমানে তাদের হেফাজতে রয়েছে। এই নাম্বার থেকে এটাই তাদের শেষ কল।পরে অন্য নাম্বার থেকে কল দেয়া হবে।

মাহফুজকে ফিরে পেতে হলে তাদেরকে ১ লাখ টাকা মুক্তিপন দিতে হবে। নতুবা তাকে হত্যা করা হবে। এ কথা বলে রাসেলকে ৪টি বিকাশ ও ৩টি রকেট নাম্বার দেয়। এরপর রাসেল ও তার পিতা আ: মান্নান সরকার অনন্যোপায় হয়ে মাহফুজকে বাঁচানোর জন্য ৩টি রকেট নাম্বারে ১ লক্ষ টাকা পরিশোধ করে। এরপরও তারা মাহফুজকে ফেরত পেয়ে নরসিংদী সদর থানায় একটি অপহরণ মামলা দায়ের করে।
২৮ মে নরসিংদী শহরের রাঙ্গামাটিয়া মহল্লার প্রবাসী আল-মামুুনের স্ত্রী ইনডেক্স প্লাজার এমডি গার্মেন্টস নামে একটি দোকানের মালিক রাবেয়া ইসলাম রাবু মাহফুজের বাড়ীতে গিয়ে তার নিখোঁজের ব্যাপারে অযাচিত খোঁজখবর নেয়। মাহফুজের পিতা-মাতা ও ভাই-বোনদের নিকট সহানুভূতি প্রকাশ করে রাবু জানায় যে, মাহফুজকে সে খুবই আদর-স্নেহ করতো। মাহফুজ তার নিকট থেকে টাকা ধার নিতো, আবার দিয়ে দিতো। তার সাথে খুবই সু-সম্পর্ক ছিল। এসব কথা বলে রাবু, মাহফুজকে খোঁজাখুজি করার জন্য বিভিন্ন এলাকার কয়েকজন ব্যক্তির নাম ঠিকানা দেয়।

জানায় যে, এসব ব্যক্তিদের সাথে মাহফুজের শত্র“তা ছিল। রাবু’র এধরনের কথা বার্তায় মাহফুজের পিতা-মাতা ও ভাই-বোনদের মনে সন্দেহের উদ্রেক করলে তারা ঘটনাটি অপহরণ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নরসিংদী থানার এসআই নুরে আলমকে জানায়। এসআই নুরে আলম ঘটনা বিস্তারিত জেনে মোবাইল ফোনে রাবুকে থানায় যেতে বলে। পুলিশের খবর পেয়ে রাবু অনেকটা বিচলিত হয়ে পড়লেও সে মাহফুজদের বাড়ীতে গিয়ে জানায় যে, আমি আপনাদেরকে সহযোগিতা করলাম, আর আপনারা আমার কথা পুলিশকে বলে দিলেন বলে খেদোক্তি প্রকাশ করে। পরে আবার বলতে থাকে অসুবিধা নেই, মাহফুজ আমার ছোট ভাই, তার জন্য জীবন গেলেও আমার কোন আপত্তি নেই।

এই কথা বলে রাবু তার আরো দুই বোনকে নিয়ে নরসিংদী সদর মডেল থানায় গিয়ে এসআই নুরে আলমের সাথে দেখা করেন। কথা বার্তার এক পর্যায়ে এসআই নুরে আলম তাকে থানায় আটকে রেখে দুই বোনকে বিদায় করে দেয়। এরপর এসআই নুরে আলম তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। কিন্তু সে কোন ক্লু দেয়নি। পরে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) শাহরিয়ার আলম ও ওসি গোলাম মোস্তফা যৌথভাবে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।

এতেও সে পুলিশকে কোনপ্রকার ক্লু দেয়নি। পরে সোমবার রাতে পুলিশ তাকে নরসিংদী পুলিশ অফিসে নিয়ে পুলিশ সুপার আমেনা বেগমের সামনে উপস্থাপন করে। পুলিশ সুপার আমেনা বেগম তার সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বার্তা বলার পর তার মনে সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়। এক পর্যায়ে তিনি তাকে গভীরভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে মাহফুজকে খুনের কথা স্বীকার করে। পরে গত মঙ্গলবার পুলিশ তাকে নরসিংদীর অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক ফেরদৌস ওয়াহিদের নিকট ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করে।

এতে সে স্বীকার করে যে, ২৬ মে রাতে বাড়ী থেকে বের হবার পর সে মাহফুজকে ডেকে তার বাড়ীতে নেয়। সেখানে ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই পূর্ব পরিকল্পিতভাবে রাবু তাকে জড়িয়ে ধরে। এসময় তার রাবুর ভাগিনা শাহাদাৎ হোসেন রাজু তাকে পিছনদিক থেকে এলোপাতারি ছুরিকাঘাতে হত্যা করে।

তার মৃত্যু নিশ্চিত হবার পর রাবু ও তার ভাগিনা শাহাদাৎ হোসেন রাজু মিলে তার মৃতদেহটি ৬/৭টি খন্ডে খন্ডিত করে ঘরে থাকা ডিপ ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখে। পর দিন শনিবার ফ্রিজ থেকে খন্ডিত দেহটি একটি ট্রলি ব্যাগে ঢুকিয়ে নৌকা ঘাটে গিয়ে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে ট্রলিব্যাগে ভর্তি লাশটি নিয়ে পাশ্ববর্তী বাঞ্ছারামপুর উপজেলার মরিচাকান্দী এলাকায় মেঘনা নদীর গভীর পানিতে ফেলে দেয়।

স্বীকারোক্তির পর পুলিশ মাহফুজকে হত্যার কাজে ব্যবহৃত রক্তমাখা ছুরি ও মাহফুজের গায়ে থাকা কাপড় চোপড় উদ্ধার করা হয়েছে। তবে পুলিশ এখনো লাশের তল্লাশী অভিযান শুরু করেনি। এব্যাপারে নরসিংদী সদর মডেল থানার ওসি গোলাম মোস্তফা সাংবাদিকদেরকে জানিয়েছেন, ঘটনাস্থল শনাক্ত করার পর ডুবুরী দল নিয়ে তল্লাশী চালানো হবে।