হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি

অনলাইন ডেস্ক : আমেরিকা ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একটা গল্প প্রচলিত আছে। এক বিশাল দ্বীপ নিয়ে গল্পটি তৈরি। এই দ্বীপে প্রায় পাঁচ লাখ লোকের বাস। দ্বীপটির নিরাপত্তা ঝুঁকি প্রকট। দ্বীপবাসী দেখল উজ্জ্বল এক আলোকবর্তিকা ধীরে ধীরে আকাশ থেকে নেমে আসছে। তারা একে অনুসরণ করল এবং একটি বড় ফাঁকা মাঠে তা এসে থামল। অর্থাৎ সেটাই ছিল একজন দেবদূত। চারদিকে হাজার হাজার মানুষ এসে জমা হলেন। তারা তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। দেবদূত বললেন, তোমাদের এত লোকের সঙ্গে তো আমার কথা বলা সম্ভব নয়, বরং তোমরা তিনজন প্রতিনিধি নির্বাচন করে দাও আমি তাদের কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করব ও কথা বলব। তারা তিনজন প্রতিনিধি নির্বাচন করে দিলেন। একজন বৃদ্ধ শতায়ু, আরেকজন আধুনিক ফিটফাট কেতাদুরস্ত, অন্যজন সাদাসিধা বুদ্ধিদীপ্ত ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলেই মনে হয়। প্রথমে বৃদ্ধ এলেন দেবদূত কুশল বিনিময়ের পর জিজ্ঞাসা করলেন, এখন থেকে আটচল্লিশ ঘণ্টা পর তোমাদের এই দ্বীপে জলোচ্ছ্বাস হবে এবং বাড়িঘর, সহায়-সম্পদসহ তোমাদের সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। তুমি এখন কী করবে? বৃদ্ধ ব্যক্তি বললেন, আমি জীবনে অনেক পাপ করেছি, এখন বয়স হয়েছে আর বেশি দিন বাঁচব না, এই সময়ে কান্নাকাটি করে বিধাতার দরবারে মাফ চেয়ে নেব। যাতে পরকালে আমার ভালো হয়। দ্বিতীয় ব্যক্তি একই প্রশ্নের উত্তরে বললেন, জীবনে আমি অনেক কিছুই ভোগ করেছি এখন যতটুকু সময় অবসর আছে খাওয়া-দাওয়া ফুর্তি ইত্যাদি সেরে নেব। মৃত্যুর পর কী পাব না পাব, তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। এবার তৃতীয় ব্যক্তি একই প্রশ্নের উত্তরে চিন্তা করে বললেন, (৪৮ ঘণ্টাকে মনে মনে মিনিট ও সেকেন্ড হিসাব করে নিলেন) এখনো ১ লাখ ৭২ হাজার ৮০০ সেকেন্ড সময় আছে আমি আমার দ্বীপের ৫ লাখ লোককে সংগঠিত করে তাদের ১০ লাখ হাতকে কাজে লাগাব এবং জলোচ্ছ্বাস আসার আগেই দ্বীপের চারদিকে এমন বাঁধ নির্মাণ করব, যাতে জলোচ্ছ্বাসের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করতে না পারে এবং একটি লোকেরও যেন জান ও মালের ক্ষতি না হয়।

দেবদূত তার কথা শুনে অত্যন্ত খুশি হলেন এবং তাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমি তোমার সঙ্গে আছি। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অভাব-অনটন, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাবিরোধীদের যে জলোচ্ছ্বাস তার মোকাবিলার জন্য বাঁধ তৈরিতে উদ্বুদ্ধ ও কাজে লাগানো হচ্ছে নেতা বা রাজনীতিকের কাজ। আপামর জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করাই নেতার সাফল্য। এমন মহান নেতাকে আমরা চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি। টুঙ্গিপাড়ায় চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধু আর কোনো দিন কথা বলবেন না আর কখনো তার কণ্ঠে উচ্চারিত হবে না দুখিনী বাংলা মায়ের দাবি আদায়ের কথা। যার সব বুকজুড়েই ছিল বাংলাদেশের মানচিত্র, যার অপেক্ষায় ছিল ৭৫-এর ১৫ আগস্ট ভোরের সূর্য, সেদিন প্রতীক্ষায় ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকগণ এবং সাড়ে সাত কোটি বাঙালি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুতে বিশ্বকবি লিখেছিলেন, এনেছিলে সঙ্গে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান। ঘৃণ্য ঘাতকরা স্টেনগানের একঝাঁক বুলেট দিয়ে চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দেয় এক মহান রাষ্ট্রনায়ককে, এক নিয়তি নির্মাতাকে, যুগস্রষ্টাকে। জাতির পক্ষ থেকে দেওয়া এক অমোচনীয় কালিমা, যা কখনো অপসৃত হওয়ার নয়। দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের। কোটি কোটি দেশপ্রেমিকের পুতপবিত্র ধারায় গড়ে ওঠা এই বাংলাদেশটাই তার স্মৃতির মিনার।

শস্য-শ্যামলা এই মাতৃভূমিকে তিনি ধ্যানে, প্রাণে তার প্রথম ও শেষ পবিত্র ভূমি বলে নির্ধারণ করেন। জীবনে ও মরণে বাংলাদেশকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে। এই মৃত্তিকা পবিত্র থেকে পবিত্রতর হয়েছে তারই বুকে ভেজা তাজা রক্তে। অবিনাশী আপন কীর্তিসমূহ পেছনে ফেলে তার জীবনে রথ দিগন্তে পৌঁছে গেলে এখানে রচিত হয়েছে তার অন্তিমশয়ান। হৃদয়বিদারক মমস্পর্শী ঘটনা চিরদিনই মনে থাকে। একটি আত্মাহুতি একটি জনপদকে আলোড়িত করতে পারে, একটি দুর্ঘটনা (সড়ক, নৌ, বিমান, ট্রেন) মানুষের অনুভূতিতে কয়েক দিনের জন্য ব্যথা বা ক্ষতের সৃষ্টি করতে পারে; কিন্তু একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক, সরকারপ্রধান, অবিসংবাদিত, ক্যারিজম্যাটিক বা সম্মোহনী শক্তিসম্পন্ন নেতার হত্যাকান্ড অথবা শাহাদতবরণ প্রজন্মের পর প্রজন্ম, যুগের পর যুগ একটি দেশ, জাতি বা রাষ্ট্রকে অনুপ্রাণিত করে। সেই অনুপ্রেরণার আভায় উদ্ভাসিত বাংলার আকাশে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক এক নক্ষত্র চিরভাস্বর প্রতিভাধরের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাঙালির হাজার বছরের চিরন্তন সংগ্রামের ইতিহাসে এক বিশাল অধ্যায়ের শিরোনাম। এই দেশ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শাসনামলে অনেক রাজধানী ছিল। যেমন মুর্শিদাবাদ, গৌড়, একডালা, কর্ণসুবর্ণ, কমান্ত বসাক, পুন্ডনগর, পাটালিপুত্র, সোনারগাঁও, বিক্রমপুর, লক্ষণাবর্তী, পান্ডুয়া, নদীয়া বা নবদ্বীপ। কিন্তু ঢাকাকে রাজধানী করে এই ভূখন্ডে স্বাধীন প্রথম বাঙালি শাসক শেখ মুুজিবুর রহমান। দেশি এবং বিদেশি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তার রয়েছে সংগ্রামের বর্ণাঢ্য ইতিহাস। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার ফলে বিদেশি শাসকদের আমরা শাসিত হয়েছি। পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে, বড় মাছ যেভাবে ছোট মাছকে নদী বা পুকুরে গিলে খায়, আমাদের অবস্থা ঠিক সেরকমই হয়েছিল। শত শ্রদ্ধা রেখেই লিখছি হাজী শরীয়তুল্লাহ, তিতুমীর, সূর্যসেন, প্রীতিলতা, হক, ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী যা আমাদের দিতে পারেনি সেই মহান স্বাধীনতা তিনি আমাদের এনে দিয়েছেন আর এটা সম্ভব হয়েছে তার সম্মোহনী নেতৃত্বের কারণে। ক্যারিজমা বা সম্মোহনী হচ্ছে নেতা ও তার অনুসারীদের মধ্যে একটি আবেগময় বন্ধন। অন্যভাবে বলা যায়, ক্যারিজমা হচ্ছে কোনো ব্যক্তির নেতৃত্বের প্রতি চরম ভক্তি বা আসক্তি এবং তার অন্যান্য গুণাবলির সহিত ব্যক্তিগত আসক্তি। যখন কোনো সমাজে বা যেকোনো দেশে নানাবিধ কারণে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গভীর সংকট দেখা দেয়, তখন ক্যারিজমা সুলভ নেতৃত্বের আবির্ভাব ঘটে। এই নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী চেতনা এনে দেয়, যা স্বাধীনতা সংগ্রাম গড়ে তুলতে সহায়তা করে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন, অদম্য সাহস ও অকুণ্ঠ আত্মত্যাগের ইতিহাস নিয়ে দেশে-বিদেশে সর্বত্র গবেষণা চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৬ মার্চ ২০০৪ থেকে প্রচারিত বিবিসি বাংলা সার্ভিসের শ্রোতা জরিপে নির্বাচিত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০ বাঙালির তালিকায় প্রথম স্থান লাভ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৪ এপ্রিল ২০০৪ ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ হিসেবে তার নাম প্রকাশ করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর ৫৫ বছরের জীবনে ১২ বছরের অধিক কেটেছে কারাগারে, জীবনের অর্ধেক কেটেছে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে, পুরো জীবন গেছে স্বাধীনতা নির্মাণে। বাংলাদেশের নামকরণ, ছাত্রনেতা হিসেবে কৃতিত্ব, প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রিত্ব লাভ, আওয়ামী লীগের জন্ম থেকে সম্পৃক্ততা, পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান নেতা, ছয় দফা দাবি পেশ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, বঙ্গবন্ধু উপাধি, ৭০-এর নির্বাচন, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, অসহযোগ আন্দোলন, স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান, মৃত্যুমুখে জেলখানায় বন্দিজীবন, স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, মাত্র সাড়ে ৩ বছরের শাসন ক্ষমতা গ্রহণ, জাতির জনক উপাধির ইতিহাসগুলো আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু আমরা কি জানি, Inclusive democracy-i কথা। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি বলেন, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব। গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সমালোচনা হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের নামে অনেক ভালো চিন্তা ও উদ্যোগ বাতিল হয়ে যায়। শুভ কাজ সংখ্যাগরিষ্ঠের চাপে পিষ্ট হয়। Inclusive democracy হলো ভালো পরামর্শ ও প্রস্তাব যদি একজনও হয় তাকে মূল্যায়ন করা উচিত। যে মহান মানুষটি কমপক্ষে একজন লোকের মতামত এবং সর্বোচ্চ লোকের মতামতকে গুরুত্ব দিতেন অর্থাৎ আপামর জনগণকে জীবন দিয়ে কী রকম ভালোবাসতেন তার একটি কথা না লিখে পারছি না।

বিশ্ববিখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট হয়তো বেকায়দায় ফেলতে বা বিব্রত করতে কিংবা সরলভাবে বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, Mr. Prime minister what is your qualification? উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, ও love my people এরপর তিনি প্রশ্ন করেন What is your disqualification? চোখ মুছতে মুছতে প্রতিভাদীপ্ত কণ্ঠে বলেন, ও love them too much, অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় সর্বনাশা কাল রাতের দৃশ্যপট মানসচক্ষে একবার ভেসে উঠলেই শিহরিত হতে হয়। বঙ্গবন্ধুর রক্তমাখা নিথর দেহের সঙ্গে আরো ছিল বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল, তার স্ত্রী সুলতানা কামাল, অপর পুত্র শেখ জামাল ও তার স্ত্রী রোজী জামাল, কনিষ্ঠপুত্র শেখ রাসেল, ভাই শেখ নাসের ও কর্নেল জামিলের মৃতদেহ। অন্য বাড়িতে শেখ ফজলুল হক মনি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, আবদুর রব সেরনিয়াবাত, শহীদ সেরনিয়াবাত, শিশু বাবু, আরিফ, রিন্টু খানসহ অনেকের লাশ। এখনো বারবার আবৃত্তি করতে ভালো লাগে পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের ‘কবর’ কবিতাখানি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘অগ্নিবীণা’, বহুমুখী প্রতিভার নোবেলজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী গান গাইতে, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ এবং হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের কালজয়ী ভাষণ, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’