একজন ‘আইয়ুব বাচ্চু’ হয়ে ওঠার গল্প

একাত্তরলাইভডেস্ক: বাংলা ব্যান্ড জগতের এক কিংবদন্তী নাম এলআরবি। এই এলআরবির প্রাণ পুরুষের নাম আইয়ুব বাচ্চু। এই নামটি উচ্চারন হলেই মনে ভেসে উঠবে সুর, গানের মায়া, গীটারের মূর্ছনা…। যিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলা ব্যান্ডের এক মহীরুহ। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ঘাত প্রতিঘাত সয়ে এক সময় বাংলা ব্যান্ডের দুনিয়ায় সম্রাট হিসেবে হাজির হন এই নক্ষত্র।

চট্টগ্রামের যেই ছোট্ট রবিন যে এক সময় লুকিয়ে গিটার বাজাতো সেই রবিনই এক সময় আইয়ুব বাচ্চু নামে গিটার দিয়ে পুরো দুনিয়ে কাঁপিয়ে বেড়িয়েছে। মঞ্চে গিটারের ছয়টি তার মাতিয়েছেন অজস্র সঙ্গীত প্রেমীদের মন।

বাংলার সঙ্গীত জগতের এই নক্ষত্রের চিরবিদায় ঘটলো। চিরায়িত নিয়ম মেনেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে এই তারকাকে। ৫৬ বছর বয়সে বৃহস্পতিবার সকালে মারা গেছেন এই রকস্টার।

কিন্তু মৃত্যুইতো এখানে শেষ কথা নয় জীবন যেখানে রচনা করে ফেলে কিংবদন্তীর ইতিহাস। এক বনার্ঢ্য অনুকরনীয় জীবন তিনি রেখে গেছেন তার সৃষ্টির সাথে সাথে। কেমন ছিলো সেই ‘আইয়ুব বাচ্চু’ হয়ে ওঠার গল্পটি?

১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আইয়ুব বাচ্চু। তার ডাক নাম ছিলো রবিন। ছোট বেলা থেকেই আইয়ুব বাচ্চুর ছিলো সঙ্গীতের প্রতি টান। শহরের বনদী হাজি পরিবারের সন্তান ছিলেন। তাই সঙ্গীত চর্চার জন্য অনুকুল পরিবেশ ছিলো না সে সময়। পরিবারের সবাই চেয়েছেন পড়াশুনা করে চাকরি করুক কিন্তু তার ছিলো ভিন্ন ইচ্ছা। বহেমিয়ান স্বভাবের সেই কিশোর গিটারের পেছনে ছুটলেন। স্রোতের বিপরীতে ছুটে চলা সেই কিশোরকে যে কত প্রবঞ্চনা সইতে হয়েছে। কিন্তু নিজের স্বপ্ন থেকে সরে যাননি। গোপনে গেরিলা যোদ্ধার মতোই তৈরি হচ্ছিলো সেই ছোট্ট রবিন। মায়ের প্রশ্রয় পেয়েছিলেন কিছুটা।

গিটার বাজাতে বাজাতে চট্টগ্রামেই জুটে যায় বেশি কিছু সঙ্গীসাথী। ১৯৭৮ সালে ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডের মাধ্যমে ব্যান্ড জগতে যাত্রা শুরু হয় আইয়ুব বাচ্চুর। চট্টগ্রামেই তারা বিভিন্ন শো করতেন। বিভিন্ন ক্লাবে অনুষ্ঠানে গাইতেন। ফিলিংসের হয়ে চট্টগ্রামের একটি হোটেলে গান গাইতেন আইয়ুব বাচ্চু।

আশির দশকে যোগ দেন সোলস ব্যান্ডে। ৮০ থেকে ৯০ সাল পর্যন্ত তিনি সোলস ব্যান্ডেই ছিলেন। হার্ড রক ধরনের গান করার জন্য ১৯৯০ এর দশকে তিনি ‘এলআরবি’ গঠন করেন। ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু, জয়, স্বপন এবং এস আই টুটুল। এরপর একে একে যোগ দেন মিল্টন, রিয়াদ, সুমন ও কাজী হাবলু। এলআরবি প্রথম কনসার্ট করে ঢাকার একটি আন্তর্জাতিক ক্লাবে। শুরুটা ছিল ইংরেজি গান দিয়ে। বহু কনসার্টে শ্রোতা-ভক্তের চাহিদার কারণে রাত কেটে গেছে এমন নজিরও আছে।

সেসময় ১৯৯১ সালে এলআরবি নামে একটি এলবাম বের করেন তারা। এটি বাংলাদেশের প্রথম দ্বৈত অ্যালবাম। ওই অ্যালবামের বেশ কিচু গান ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এর আগে আইয়ুব বাচ্চুর একক অ্যালবাম বের হয়। ১৯৮৬ সালে বের হয় অ্যালবাম রক্তগোলাপ। তবে সেই অ্যালবামটি তেমন একটা সাফল্য পায়নি। এর দুই বছর পর ১৯৮৮ সালে বের হয় তার দ্বিতীয় একক অ্যালবাম ‘ময়না’। ওই অ্যালবামটি শ্রোতাদের দৃষ্টি আর্কষন করতে সক্ষম হন।

বাচ্চুর নেতৃত্বে ‘এলআরবি’ বাংলা ব্যান্ড জগতে হইচই ফেলে দেয়। একের পর এক গান দিয়ে দর্শক মাতাতে থাকেন এলআরবি। এই ‘এলআরবি’র জনপ্রিয়তার পেছনেও আছে অনেক সংগ্রাম আর কষ্টের গল্প। গান নিয়ে আইয়ুব বাচ্চু ছুটে আসেন ঢাকায়। তখনও আইয়ুব বাচ্চু খ্যাতি পাননি। আকাশ সমান স্বপ্ন নিয়ে ঘুরে বেড়ান। ছোট ছোট অনুষ্ঠানে গাইছেন বড় একটি ব্যান্ড গড়ে তোলার জন্য। গায়ক কুমার বিশ্বজিত ছিলো তার সেই সময়কার বন্ধুদের একজন। তারা এক সাথে গাইতেন, প্রাকটিস করতেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে।

একটি স্বাক্ষাতকারে সেই সময়ের সংগ্রামের গল্প বলতে গিয়ে আইয়ুব বাচ্চু বলেছিলেন, আমাদের সেই সময়ে (৭৮ সাল) গান গাওয়ার জায়গা ছিলো বিয়ে বাড়ি। বিভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠানে আমাদের নিয়ে যাওয়া হতো। সন্ধ্যা থেকে সারারাত গাইতে হতো। কারণ উদ্দেশ্য ছিলো বরযাত্রী যারা আসবেন তাদেরকে ব্যস্ত রাখা। যেহেতু প্রচুর মানুষ আসতো এতো মানুষের ঘুমানোর জায়গা হতোনা কনে পক্ষের বাসায় তাই সারারাত ব্যস্ত রাখতে হতো গান দিয়ে। কখনো বা চুক্তি হতো যে গান গেয়ে মানুষকে নাচাতে পারলে ‘পেমেন্টে’ ( সন্মানি) দেয়া হবে। কেউ হয়তো বা এসে বলতো বরের অমুকে নাচাও কনের ‘অমুককে নাচাও। কেন উনি নাচেনি…’ ইত্যাদি কথা আমরা ফেস করতাম। কখনো পারিশ্রমিক না দিয়েই পাঠিয়ে দেয়া হতো। কখনো একজনের ভাজি ভাগ করে ৫ জন খেয়েছি। কখনো বা ফুটপাথেই ঘুমিয়ে পরেছি। অনেক কষ্ট করেছি। কষ্ট না করলে লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না।’

সংগ্রামের এমন অসংখ্য গল্প পাড়ি দিয়েই আইয়ুব বাচ্চু হয়ে ওঠেন বাংলা ব্যান্ডের আইকন। ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ব্যান্ড অ্যালবাম সুখ ও তবুও বের হয়। সুখ অ্যালবামের “সুখ, “চলো বদলে যাই”, “রূপালি গিটার”, “গতকাল রাতে” উল্লেখযোগ্য গান। “চলো বদলে যাই” বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতে অন্যতম জনপ্রিয় একটি গান। গানটির কথা লিখেছেন ও সুর করেছেন বাচ্চু নিজেই। ১৯৯৫ সালে তিনি বের করেন তৃতীয় একক অ্যালবাম কষ্ট। সর্বকালের সেরা একক অ্যালবামের একটি বলে অভিহিত করা হয় এটিকে। এই অ্যালবামের প্রায় সবগুলো গানই জনপ্রিয়তা পায়। বিশেষ করে “কষ্ট কাকে বলে”, “কষ্ট পেতে ভালোবাসি”, “অবাক হৃদয়”, ও “আমিও মানুষ”। একই বছর তার চতুর্থ ব্যান্ড অ্যালবাম ঘুমন্ত শহরে প্রকাশিত হয়।

একে একে নতুন নতুন গান আর অ্যালবাম দিয়ে এলআরবির প্রজন্মকে বেধে ফেলেন নিজের সাথে। আইয়ুব বাচ্চুর সুরের মূর্ছনায় আটকা পরে আছে কয়েক প্রজন্ম। এই শিল্পীর চির প্রস্থানের দিনে কয়েক দশকের স্মৃতি বয়ে বেরানো প্রজন্মের বুকে শুধু বিষন্ন বিদায়ের অচেনা সুর বাজছে এখন।