৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বিশাল বাজেট প্রস্তাব

অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতার শুরুতেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ এবং অন্যান্য আন্দোলনে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এ সময় তিনি বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের অপ-রাজনীতির শিকার হয়ে অকালে প্রাণ হারিয়েছেন কিংবা অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন যারা, তাদের প্রতি সমবেদনা জানান।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত স্পিকারের অনুমতি নিয়ে নিজ আসনে বসে পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে তার বাজেট বক্তৃতা শুরু করেন।Upload Files

অর্থমন্ত্রী ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের জন্য মোট ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা ব্যয় হবে বলে প্রস্তাব করেছেন। অনুন্নয়ন রাজস্ব ব্যয় ২ লাখ ৭ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা আর উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৫৯ হাজার ১৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ১ লাখ ৫৩ হজার ৩৩১ কোটি টাকা এবং অন্যান্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৪ হাজার ১১৫ কোটি টাকা।

অন্যদিকে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর কর থেকে আয় হবে ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এনবিআর বহির্ভুত কর থেকে আসবে ৮ হাজার ৬২২ কোটি টাকা এবং কর ব্যতীত প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৩১ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে ১ হাজার ১২ লাখ ২৭৫ কোটি টাকা।

বাজেটের অর্থায়নে বৈদেশিক উৎস থেকে আসবে ৫১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৬০ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা, এর মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেওয়া হবে ২৮ হাজার ২০৩ কোটি টাকা।

অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো, অর্থনীতির সব খাতের সুষম ও সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নয়ন। আমরা সাধারণত একটি মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামোর আওতায় বাজেট কাঠামো প্রস্তুত করে এ লক্ষ্য অর্জন করতে চাই। মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামো প্রতি বছরই হালনাগাদ করা হয়। এ ক্ষেত্রে সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যান্য খাত যথা প্রকৃত, মুদ্রা ও বহিঃখাতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি আয় ও ব্যয় সীমা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখার স্বার্থে আমরা বাজেটের আয় ও ব্যয়ের পরিমাণকে একটি নিরাপদ সীমার মধ্যে নির্ধারণ করি। পাশাপাশি, সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বাজেট ঘাটতির পরিমাণ ও ঘাটতি অর্থায়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকি।’

তিনি বলেন, ‘বাজেট কাঠামো প্রস্তুতের ক্ষেত্রে আমরা সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার পাশাপাশি টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাগুলোও বিবেচনায় নিয়েছি। আমার বিশ্বাস প্রস্তাবিত বাজেট কাঠামো, সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাসহ টেকসই উন্নয়নের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনীয় সম্পদ সঞ্চালনে সক্ষম হবে।’

অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রস্তাবিত বাজেট কাঠামো যেসব অনুমানের ভিত্তিতে প্রণয়ন করা হয়েছে, আমি তা উল্লেখ করতে চাই, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হবে ৭ দমমিক ৪ শতাংশ এবং বছর শেষে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসবে।

তিনি বলেন, সুদের হার ক্রমহৃাসমান ধারায় ও নমিনাল বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকবে। ভোগ ও বিনিয়োগ ব্যয় বৃদ্ধির প্রভাবে অভ্যন্তরীণ ভোগ আগের তুলনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়বে। ফলে, চলতি হিসাবের ভারসাম্যে সামান্য ঘাটতি সৃষ্টি হবে। তবে, মূলধন ও আর্থিক হিসাবে পর্যাপ্ত উদ্বৃত্ত থাকায় সার্বিক লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত থাকবে।

মুহিত বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রবৃদ্ধি সহায়ক মুদ্রা ও ঋণ নীতি অব্যাহত থাকবে। কর-রাজস্ব আয় জিডিপির ১ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। করের পরিধি সম্প্রসারণ এবং নতুন মূল্য সংযোজন কর আইনের বাস্তবায়ন হবে। কর অব্যাহতি ও কর অবকাশ ক্রমান্বয়ে প্রত্যাহার করা হবে। প্রতিশ্রুত বৈদেশিক সাহায্যের অবমুক্তি বৃদ্ধি পাবে। বিশ্ব উৎপাদন প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধার অব্যাহত থাকবে এবং লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রপ্তানি ও প্রবাস আয় অর্জিত হবে। সর্বোপরি জনগণের কর্মোদ্যম এবং কৃষক ও শ্রমিকের কাজের প্রতি আগ্রহ দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিঘ্ন হতে দেবে না।

বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে স্পিকারের উদ্দেশে অর্থমন্ত্রী মুহিত বলেন, আমাদের যেতে হবে অনেক দূর।

এ সময় তিনি মার্কিন কবি রবার্ট ফ্রস্ট্রের লেখা থেকে উদ্বৃত করেন,

`But I have promises to keep.

And miles to go before I sleep.’

তিনি বলেন, সুশাসনের জন্য আমরা অনেক বাধা বিপত্তির মোকাবিলা করেছি। কে ভেবেছিল এ দেশে রাজাকারেরা ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলবে? কে বিশ্বাস করেছিল যে, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার হবে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছেন। আমরা কী কখনো ভেবেছি যে, আমরা ভিক্ষার ঝুলিকে এত দ্রুত ছেঁটে ফেলতে পারব? নিজস্ব অর্থায়নে কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারব? পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারব? শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা সমৃদ্ধির পথে হাঁটছি। সোনা ছড়ানো সমৃদ্ধি আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সময় এসেছে সাহসী রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আলোর পথে অভিযাত্রার।

তিনি বলেন, ২০৪১ এর লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদের ৮-১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। এজন্য উৎপাদনের উপকরণ পুঞ্জিভূতকরণের পাশাপাশি এগুলোর উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে ব্যাপকভাবে। নতুন প্রযুক্তি ও উন্নত ব্যবস্থাপনার আওতায় দেশের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় আনতে হবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। নিশ্চিত করতে হবে উৎপাদন নৈপুণ্যের উৎকর্ষায়ন। এজন্য প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠার বর্তমান ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। গড়ে তুলতে হবে কার্যকর মানব-মূলধন মজুদ। কণ্টকমুক্ত রাখতে হবে ব্যক্তিখাত বিকাশের পথকে। তদুপরি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্প্রসারণের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। এসব কাজ পরিকল্পিত উপায়ে সম্পাদনের জন্য আমরা রূপকল্প ২০৪১ এর আওতায় প্রণয়ন করতে যাচ্ছি দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা। এর স্বপ্নমূলে থাকবে একটি শান্তিপ্রিয়, উন্নত এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সুস্থ সবল আলোকময় বাংলাদেশ।

মুহিত বলেন, জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের উচ্চাভিলাষ ব্যক্ত করেন সোনার বাংলার স্লোগান দিয়ে। তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা দেন যে, মুক্তিযুদ্ধে নির্মমভাবে বিধ্বস্ত বাংলাদেশে সম্পদের অভাব নেই, শুধু তার সদ্ব্যবহারের ব্যবস্থা ছিল পশ্চাৎপদ। আমরা এখন জানি যে তার উচ্চাভিলাষ শুধুই স্বপ্ন ছিল না, ছিল আত্মবিশ্বাস ও আত্মপ্রত্যয়ের অভিব্যক্তি। ধ্বংসের স্তুপ থেকে ফিনিক্স যখন মাত্র জেগে উঠার প্রস্তুতি নেয়, তখনই ঘৃণ্য রাজাকার এবং দেশশত্রুরা তাদের চরম আঘাত হানে। জাতির স্থপতিকে হ্ত্যা করা হয়। তাঁর স্বপ্ন তাঁর জীবনে অধরাই থেকে যায়। আল্লাহর অশেষ রহমতে এবং তার বান্দা বাংলাদেশিদের মাথা নত না করার মনোবলের জোরে আমরা আমাদের দুরবস্থা থেকে উত্তরণের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাই।

অর্থমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর তিরোধানের একুশ বছর পরে আমরা সুষ্ঠুভাবে দেশ পুনর্গঠন কাজে লিপ্ত হই। পাঁচ বছরের শেষে আমরা আবার প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির নির্যাতনের শিকার হই। অতঃপর ২০০৯ সাল থেকে ভোটের লড়াইয়ে জয়যুক্ত হয়ে আমরা আবার জনসেবার সুযোগ পাই। জনকল্যাণ আবার হয় আমাদের জাতীয় ব্রত। নিরবচ্ছিন্নভাবে পরবর্তী নয় বছরে আমাদের পরিকল্পনা, প্রস্তুতি ও উন্নয়ন কৌশল আমাদের নিয়ে এসেছে বর্তমান অবস্থানে। দিন এসেছে দল, মত, হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে সকলে মিলে সে পথ ধরে সামনে এগিয়ে চলার। আসুন আমরা এখন প্রস্তুতি নেই ২০৪১ সালের সমৃদ্ধ, উন্নত, সুখী ও শান্তিময় বাংলাদেশের জন্য।