গাইবান্ধা প্রতিনিধি:
সুন্দরগঞ্জের এমপি লিটনের স্ত্রী ও জেলা আওয়ামী লীগ নেত্রী খুরশিদ জাহান স্মৃতি বলেছেন, জামায়াত নেতা গোলাম আজমের সভাকে পন্ড করার ক্ষোভকে জিইয়ে রেখেই জামায়াত-শিবির চক্র তার স্বামীকে হত্যা করেছে।
তিনি বলেন, বিগত ১৯৯৮ সালের ২৬ জুন সুন্দরগঞ্জ ডি ডাব্লিউ ডিগ্রী কলেজ মাঠে জামায়াত-শিবির আয়োজিত জনসভায় গোলাম আজমের বক্তব্য দেয়ার কথা ছিল। সেসময় স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের এই সভা পন্ড করে দিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ লিটন তার বন্দুক হাতে কর্মী সমর্থকদের নিয়ে ওই জনসভায় প্রবেশ করে গোলাম আজমকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোঁড়েন। এতে জনসভাটি পন্ড হয়ে যায়। ফলে সেই থেকে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার বাহিনী লিটনকে যে কোনমূল্যে হত্যার টার্গেট করে রেখেছিল। সেসময় তার গুলিতে আহত জামায়াতের ফতেখাঁ গ্রামের ক্যাডার হেফজ সহ আরও দুর্ধর্ষ জামায়াত ক্যাডাররা লিটনকে মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়ে এবং মোবাইল করে দীর্ঘদিন থেকেই হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল।
লিটনকে ৩১ ডিসেম্বর শনিবার সন্ধ্যায় গুলি করে এই নির্মম হত্যা তারই জের বলে উল্লেখ করে তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন, ওই গোলাম আজমের জামায়াত-শিবিরের খুনিরাই তার স্বামীকে হত্যা করেছে। তিনি মর্মান্তিক এই হত্যার বিচার চান এবং দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ২০১৫ সালের ২ অক্টোবর ভোরে শিশু শাহাদত হোসেন সৌরভকে গুলি ছোঁড়ার একটি পরিকল্পিত মিথ্যা ঘটনাকে কেন্দ্র করে এমপি লিটনের লাইসেন্সকৃত রিভলবার ও শটগান জব্দ করে নেয়া হয়। খুনি জামায়াত-শিবির চক্র জানতো তার বাড়িতে তাদের প্রতিরোধ করার মত কোন অস্ত্র নেই। সেই সুযোগে তারা বাড়িতে এসে পরিকল্পিতভাবে খুনিরা তাকে হত্যা করতে সাহসী হয় বলে স্মৃতি জানান।
তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন বিকেলে অনেক নেতাকর্মী বাড়িতে থাকতো। এছাড়া তার বাড়িতে পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা ছিল রাতে। সাধারণত সন্ধ্যার আগেই নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে এমপি লিটন বামনডাঙ্গা রেল স্টেশন সংলগ্ন তার অফিসে গিয়ে বসেন এবং রাত ৯টা থেকে ১০টা অবধি সেখানে থাকেন। কিন্তু কেন জানিনা সেদিন কোন নেতাকর্মী তার বাড়িতে ছিল না। বাড়িতে শুধু তিনি তার ভাই সৈয়দ বেদারুল আহসান বেতার, ভাগ্নি শিমু, চাচি স্মৃতি খাতুন এবং বাড়ির কেয়ার টেকার ইসমাইল, ইউসুফ ও সৌমিত্র ছিল। এসময় তিনি ও তার ভাই বাড়ির উঠোনের রান্না ঘরের কাছে ছিলেন। সেসময় গুলির শব্দ শুনতে পান এবং লিটন ঘর থেকে বাড়ির ভেতর দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে বলেন ওরা আমাকে গুলি করেছে, আগে ওদের ধরো। এসময় তিনি বুকে হাত দিয়ে ছিলেন এবং বুকের বাম পাশ দিয়ে রক্ত ঝরছিল। বাড়ির সামনে ড্রাইভার এমপির চিৎকার শুনে এবং আততায়ীদের ছুটতে দেখে গাড়ি নিয়েই তাদের ধাওয়া করেন।
আহত লিটনকে সাথে নিয়ে স্মৃতি, ইসমাইল ও বেতার গাবগাছ তলায় বেরিয়ে আসেন। সেসময় আহত লিটন দাড়িয়ে থাকতেও পারছিলেন না। ড্রাইভার ও গাড়ি না থাকায় একটি মটর সাইকেলের মাঝখানে বসিয়ে আহত লিটনের কথামত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এসময় ড্রাইভার এসে পড়লে সেই গাড়িতে চড়েই প্রতিবেশী নয়ন ও রেজাউল এবং বেতারসহ এমপি লিটনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দেন বলে জানান।
তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, সুন্দরগঞ্জে দলীয় কোন কোন্দল নেই। লিটন এমপি হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। তবে তার একমাত্র শত্রু ছিল স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত-শিবির চক্র। যাকে তিনি আওয়ামী লীগের আদর্শে অনুপ্রাণিত রাজনীতিতে কোণঠাসা করে ফেলেছিলেন। যার প্রতিশোধ তারা এই ত্যাগী নেতার রক্ত ঝরিয়ে নিয়েছে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এমপির শ্যালক সৈয়দ বেদারুল ইসলাম বেতার কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, যে দু’জন খুনি লিটনের সাথে কথা বলার অনুরোধ জানিয়ে তার সাথে ঘরে ঢোকেন তারা গিয়ে সামনের সোফায় বসে পড়েন। খুনি দু’জনার মুখ খোলা থাকলেও মাথা ও কান মাপলারে ঢাকা ছিল এবং তাদের পরণে ছিল কালো জ্যাকেট ও কালো প্যান্ট। তারা বহিরাগত ছিল না, কারণ তারা গাইবান্ধা এলাকার আঞ্চলিক ভাষা দিয়ে কথা বলছিল।
তিনি কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, গুরুতর আহত লিটনকে নিয়ে যখন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাচ্ছিল তখন তার শেষ দুটো কথা ছিল, তিনি নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না। তার অক্সিজেনের দরকার। এরপর তিনি চিৎকার করে স্ত্রী স্মৃতিকে বলেন, হাসপাতাল আর কতদূর। এটাই তার শেষ কথা। এরপর তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।