একাত্তর লাইভ ডেস্ক:
মহান আল্লাহর অনন্য সৃষ্টি মানুষ। যাদের ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব বলে অভিহিত করা হয়। অন্যান্য প্রাণিকুলের থেকে মানুষই সর্বেসর্বা। দুনিয়ায় মানুষের জীবনকে সহজীকরণ করে তোলা ও পারলৌকিক মুক্তির নিশ্চয়তা বিধানকল্পে মহান আল্লাহ যুগে যুগে নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন। মানুষকে অভিহিত করা হয়েছে আল্লাহর ‘আবদ’ বা গোলাম বা বান্দা হিসেবে। নবী-রাসুলরা আল্লাহ তায়ালার ‘আবদ’ বা বান্দা। তবে আমাদের প্রিয়নবী (সা.) কে মহান আল্লাহ ‘সর্বশ্রেষ্ঠ বান্দা’ হিসেবে অভিষিক্ত করেছেন। মানুষমাত্রই ‘আবদ’ বা বান্দা, আর তিনি (সা.)ও একজন বান্দা; কিন্তু সর্বগুণে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ।
মহান আল্লাহ তায়ালা যখন তাঁর সৃষ্টি কোনো মানুষকে ‘আমার আবদ’ বা আমার বান্দা বলে পরিচয় দেন, তখন তা সাধারণ অর্থ বহন করে না। আল্লাহর ব্যবহৃত ‘আবদ’ শব্দ সাধারণ মানুষের বেলায় সাধারণই থাকে। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা যাকে ‘আমার আবদ বা বান্দা’ বলেন, তখন সে বান্দা বা ‘আবদ’ ‘আবদিয়্যাত’ও অদ্বিতীয় তুলনাহীন হয়ে যায়। ‘আমার আবদ বান্দা’ বলে অভিহিত করার অর্থই হলো, বান্দা ‘আবদিয়্যাত’ এর সব স্তর অতিক্রম করে মাবুদ বা মহান মুনিবের সান্নিধ্যে নিজের অবস্থান করে নিয়েছেন। নবী করিম (সা.) মহান আল্লাহ তায়ালার সেই একক ও দ্বিতীয় তুলনাহীন ‘আবদ’ বা বান্দা।
পবিত্র কোরআন হলো সৃষ্টির প্রতি স্রষ্টা মহান মালিক আল্লাহ তায়ালার আদেশ, নিষেধ, পছন্দ-অপছন্দ ও অন্যান্য নিয়ম পদ্ধতির সমষ্টি এবং এটি একটি অতি মর্যাদার কিতাব। আর নবী করিম (সা.) হলেন এ কিতাবের বাহক এবং জীবন্ত কোরআন। তিনি ছিলেন চলমান কোরআনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। আয়েশা (রা.) এর কাছে সাহাবিরা জানতে চেয়েছিলেন, ‘আল্লাহর রাসুল (সা.) এর জীবনধারা কেমন ছিল বলুন! জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা কি কোরআন পড়ো না? কোরআনই তাঁর জীবনধারা।’ অর্থাৎ সৃষ্টির প্রতি স্রষ্টার যে অধিকারগুলো রয়েছে, স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টিকে যেমন দেখতে চান এবং যে স্তরে তিনি সৃষ্টিকে উপনীত করতে চান, নবী করিম (সা.) সে অধিকারগুলো এমনভাবে আদায় করেন যে, তিনি পূর্ণতার অতি উচ্চে উপনীত হয়েছেন।
মহান আল্লাহ নবী করিম (সা.) এর প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করেছেন এবং মর্যাদার সর্বোচ্চ সোপানে স্থান দিয়েছেন, এরই বাস্তব প্রকাশ হলো তিনি তাঁকে ‘আবদ’ বলে অভিহত করেছেন। যেমন এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি আমার (আবদ) বান্দার ওপর যে কিতাব অবতীর্ণ করেছি, তার (সত্যতার) ব্যাপারে যদি কোনো সন্দেহ থাকে, তাহলে যাও, তার মতো (করে) একটি সূরা তোমরাও (রচনা করে) নিয়ে এসো।’ (সূরা বাকারা : ২৩)। পবিত্র মেরাজ গমন প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘পবিত্র ও মহিমান্বিত (সেই আল্লাহ তায়ালা) যিনি তাঁর বান্দাকে রাতের বেলায় মাসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসায় নিয়ে গেলেন, যার পারিপার্শ্বিকতাকে আমি বরকতময় করে রেখেছিলাম, যেন আমি তাঁকে আমার (অদৃশ্য জগতের) কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি, (মূলত) সর্বশ্রোতা ও সর্বস্রষ্টা তো স্বয়ং তিনিই।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ১)।
‘আবদ’ এর শাব্দিক অর্থ প্রিয়নবীর শানে প্রযোজ্য হয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠত্বের নিরিখে। নবী-রাসুলরা নিঃসন্দেহে আল্লাহর বান্দা, প্রিয়বন্ধু। মহান আল্লাহ তাঁদের মর্যাদা দিয়েছেন বটে, তবে ‘আবদ’ শব্দের ব্যবহার থেকে বাতিল করেননি। ঈসা (আ.) শিশু বয়সে দোলনায় শুয়ে মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ইন্নি আবদুল্লাহ’ অর্থাৎ আমি আল্লাহর বান্দা।’ অপরদিকে নবী করিম (সা.) যেমন নিজেকে আল্লাহর বান্দা বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেছেন, তেমনি মহান আল্লাহ তায়ালাও তাঁকে পরম স্নেহে পরিচয় করে দিয়েছেন ‘আমার বান্দা’ বলে।
এ জাহানে বিভিন্ন সময়ে প্রেরিত নবী-রাসুলদের মর্যাদা প্রশ্নে মহান আল্লাহ তায়ালার বিশেষ বিবেচনা রয়েছে। তিনি কোনো নবীর চেয়ে অন্য কোনো নবীকে, কোনো রাসুলের চেয়ে অপর কোনো রাসুলকে মর্যাদার দিক দিয়ে প্রাধান্য দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি একেকজন নবীকে একেকজনের ওপর মর্যাদা দান করেছি।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ৫৫)। আর বিশেষভাবে রাসুল মনোনীত করা প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের মধ্য থেকে বাণীবাহক মনোনীত করেন, মানুষদের ভেতর থেকেও তিনি রাসুল মনোনীত করেন। অবশ্যই আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও সবকিছু দেখেন।’ (সূরা হজ : ৭৫)। অনুরূপভাবে রাসুলদের মধ্যেও একেকজনের ওপর আরেকজনের মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘এই নবী-রাসুলরা, এদের কাউকে কারও ওপর আমি বেশি মর্যাদা দান করেছি। এদের মধ্যে এমনও ছিল যাদের সঙ্গে আল্লাহ তায়ালা কথা বলেছেন এবং কারও মর্যাদা তিনি বাড়িয়ে দিয়েছেন।’ (সূরা বাকারা : ২৫৩)।
সব নবী-রাসুলই আল্লাহর ‘আবদ’ বা বান্দা। মর্যাদাগতভাবে তারতম্য থাকলেও একজন নবী ও রাসুলের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর বিশেষ অনুকম্পা রয়েছে তিনি হলেন, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)। তিনি আল্লাহ তায়ালার ‘আবদ’ বা বান্দা, যাঁর প্রতি মুসলমানদের ঈমান রাখতে হবে। একজন মুসলমান তার ঈমানের স্বীকৃতি জ্ঞাপনার্থে কালেমার মাধ্যমে মহান আল্লাহ ইলাহ বা মাবুদ তাঁর রাসুলুল্লাহ (সা.) কে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হিসেবে মনে-প্রাণে বিশ্বাস ও মৌখিক উচ্চারণের মাধ্যমে স্বীকার করা হয়। মহব্বতের আতিশয্যে মহান আল্লাহর স্তরে যেন তাঁকে সমাসীন করা না হয়, সে ব্যাপারে যত্নবান থাকতে হবে। নবী করিম (সা.) সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে তা যেন আল্লাহর দেয়া সম্মান-মর্যাদার স্তর অতিক্রম লাভ না হয়।
আল্লাহর দুনিয়ায় সবাই তাঁর বান্দাহ। নবী-রাসুলদের মর্যাদা অধিক পরিমাণে বেশি হলেও প্রিয়নবী (সা.) এর মর্যাদা আরও বেশি। কোরআনের মর্মানুযায়ী মুসলিম জাতির সবাই ‘আবদ’ বা বান্দা। আর মুহাম্মদ (সা.) হলেন আল্লাহ তায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ বান্দা।