আসাদুল হক পলাশ : নরসিংদীর রায়পুরার দুর্গম চরাঞ্চল বাঁশগাড়ী ইউনয়নে আওয়ামী লীগের দুই গ্র“পের প্রভাব বিস্তার ও নেতৃত্বের কোন্দলে এ পর্যন্ত অন্তত ১০টি ছোট-বড় সংঘর্ষে ২ জন নিহত, ৫ শতাধিক লোক আহত, ২শতাধিক বাড়ী ঘর ভাংচুর, অর্ধশত বাড়ী পুড়ে ছাই এবং কমবেশী দুই-আড়াই কোটি টাকার মালামাল লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে রায়পুরা এমপি, সাবেক মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু সমর্থিত গ্র“পের পক্ষে ৩ টি মামলা এবং ত্যাগী ও বঞ্চিত আওয়ামী লীগ নেতাদের পক্ষে ২টি মামলা রুজু হয়েছে। ১এটি হত্যা মামলা রুজু হয়েছে। অপরটি রুজু হয়নি বলে নিশ্চিত করেছেন রায়পুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজহারুল ইসলাম। অপর হত্যা মামলাটি রুজু না হবার কারণ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, ক্ষমতার প্রভাব এবং অর্থনৈতিক লেনদেন বলে অভিযোগ করেছেন ভূক্তভোগী সাহেদ সরকার।
গত ১৯ এপ্রিল বুধবার দিনব্যাপী বন্ধুক ও টেটা যুদ্ধ সংঘটিত হবার পর থেকে বাঁশগাড়ী ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান সিরাজুল হক ও সাবেক চেয়ারম্যান সাহেদ সরকার এর পক্ষের দু’জন সমর্থক গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন নরসিংদী জেলা হাসপাতালে এবং অপরজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিহতের ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোন পক্ষই থানায় মামলা রুজু করাতে পারেনি।
একটি সূত্র জানিয়েছে, এমপি রাজুর আস্থাভাজন সাবেক বিএনপি নেতা বর্তমান চেয়ারম্যান সিরাজুল হক বীর দর্পে থানা পুলিশের সংগে সখ্যতা রক্ষা করছেন। তিনি তার সমর্থক মাসুদ (৩০) হত্যা মামলার ঘটনায় সাহেদ সরকারকে প্রধান আসামী করে একটি, বাড়ীঘরে অগ্নি সংযোগের একটি এবং ভাংচুর ও লুটপাটের আরো একটি এজাহার থানায় দাখিল করেছেন বলে এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন সিরাজুল হক চেয়ারম্যান। তার দাখিলকৃত ৩টি এজাহারই এফআইআর করেছে রায়পুরা থানা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তার প্রতি প্রতিপক্ষ প্রবীন আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক চেয়ারম্যান সাহেদ সরকার তার সমর্থক শারিফন (১৮) কে গুলি করে হত্যার ঘটনায় সিরাজুল হক চেয়ারম্যানকে প্রধান আসামী করে একটি, বাড়ি-ঘর ভাংচুর, লুটপাটের ১টি এবং অগ্নি সংযোগ ও নাশকতার একটি এজাহার দাখিল করেছেন। কিন্তু এমপি রাজুর আস্থাভাজন সিরাজুল হক চেয়ারম্যানকে প্রধান আসামী করায় রায়পুরা থানা পুলিশ শারফিন হত্যা অভিযোগটি গায়েব করে দিয়েছে। সহজ ধারা দিয়ে এজাহার পরিবর্তন করে নামে মাত্র দুটি মামলা এফআইআর করেছে বলে জানিয়েছেন সাহেদ সরকার।
প্রবীন আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক চেয়ারম্যান সাহেদ সরকার এ প্রতিদেককে বলেন, আমি আওয়ামী পরিবারের সন্তান। জন্ম থেকেই আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে মনে প্রানে লালন করি। সারাটা জীবন আওয়ামী লীগের পাশে থেকেছি। বর্তমানে এই আমিই আজ আওয়ামী লীগের এমপির রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে লাঞ্ছিত বঞ্চিত ও অবহেলিত। আজ পুলিশ অত্যাচারকারীদের কাউন্টার মামলা গ্রহণ করে। আর অত্যাচারে অতিষ্ঠ মজলুমদের দায়েরকৃত এজাহার গায়েব করে দেয়! জলজ্যান্ত একটি মানুষের লাশ পুলিশ উদ্ধার করে নরসিংদী সদর হাসপাতাল থেকে ময়নাতদন্ত করিয়ে স্বজনদের নিকট হস্তান্তর করেছে। অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত শারফিন (১৮) হত্যার অভিযোগ দায়েরের পরও পুলিশ মামলা নেয়নি। এজাহার প্রাপ্তির কথাও বেমালুম অস্বীকার করে যাচ্ছে। আমার জানা মতে আইনত কোন মানুষ খুন হলে কেউ অভিযোগ করুক আর নাই করুক, পুলিশ বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা রুজু করার কথা। শারফিন হত্যাকান্ডের ৪ দিন অতিবাহিত হলেও পুলিশ কেন কোন মামলা রুজু করেনি?
সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, গত ইউপি নির্বাচনে বাঁশগাড়ী ইউনিয়ন থেকে রায়পুরার সাংসদ রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু সদ্য আওয়ামী লীগে যোগদানকারী বিএনপি নেতা সিরাজুল হককে নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচন করার জন্য মনোনিত করেন। এতে স্থানীয় প্রবীন ও ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঝড় উঠে। শুরু হয় নানা আলোচনা সমালোচনা। দাঙ্গাবাজ হিসেবে খ্যাত খালেদা জিয়ার আদর্শ লালনকারী বিএনপি নেতা সিরাজুল হককে এমপি রাজুর মনোনীত করাকে রায়পুরা উপজেলা আওয়ামী লীগের ২/১ জন নেতা ছাড়া আর কেউ ভালভাবে নেননি।
তাদের পরামর্শে এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদ্য নির্বাচিত নরসিংদী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আব্দুল মতিন ভূইয়ার অনুপ্রেরণায় ওই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক চেয়ারম্যান সাহেদ সরকার কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সংগে যোগাযোগ করে নৌকা প্রতীক নিয়ে আসে। তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করলে এমপি রাজু তার পছন্দের প্রার্থী সিরাজুল হককে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহনের সিদ্ধান্ত দেন। তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিরাজুল হক নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে সাহেদ সরকারের সংগে প্রতিদ্বন্দ্বীতকরে।
স্থানীয় এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান ও প্রশাসনের অসহযোগিতার কারণে নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারেনি সাহেদ সরকার। এমপি রাজুর আর্শিবাদে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী সিরাজুল হক। তার পর শুরু হয় নির্বাচনোত্তর সহিংসতা।
দফায় দফায় চেয়ারম্যান সিরাজুল হকের চাঁদাবাজী, হামলা, মামলা, অত্যাচারে সাহেদ সরকারের সমর্থনকারী আওয়ামী পরিবারগুলো সহায় সম্বল ফেলে এলাকা ছেড়ে নরসিংদী শহর ও শহরতলীসহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতে থাকে। ২/৩ শতাধিক পরিবারের লোকজন এলাকাছাড়া থাকার সুযোগে সিরাজুল হক গ্র“পের লোকজন ঐসকল পরিবারের গরু-বাছুর, ফল-ফলাদি ও ফসলাদি লুটে নিয়ে যায়।
ঐ এলকার বাইরে চাকুরী বাকরি নিয়ে বসবাসকারী লোকেরাও তাদের চাঁদাবাজী থেকে রেহায় পায়নি। এতসব অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দিন দিন সাহেদ সরকার ও তার সমর্থকদের মনোবল বাড়তে থাকে। অতি সম্প্রতি তারা সংগঠিত হয়ে এলাকায় ফিরে যেতে পারে আশংকা থেকে সিরাজুল হক পূর্বেই এমপি রাজুসহ স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করে।
ঘটনার পূর্ব দিন সিরাজুল হকের মৌখিক আবেদনে রায়পুরা প্রশাসন বৃহস্পতিবার সকালে বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে এলাকার নিরাপত্তা বাড়ায়। যদিও ওই এলাকায় একটি স্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ি রয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল ৯ টার দিকে সাহেদ সরকার তার সমর্থক ও ভাড়া করা দাঙ্গাবাজদের নিয়ে এলাকায় উঠতে শুরু করলে সিরাজুল হক ও সমর্থকরা বিপুল পরিমান অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তাদেরকে প্রতিহত করা জন্য দাঙ্গায় নেমে পড়ে। সকাল ১০ টার দিকে শুরু হয় দাঙ্গা।
এ দাঙ্গায় কমবেশী ১৪/১৫ হাজার বিভিন্ন অস্ত্রের গুলি বিনিময় হয়। সহশ্রাধিক ককটেল বিস্ফোরিত হয়। পুড়ে ছাই করে দেয়া হয় অর্ধশতাধিক বাড়ীঘর। দুই শতাধিক বাড়ীঘর ভাংচুর ও লুটপাট করা হয়। সহায় সম্বলহীন করে দেয়া হয় নিরপেক্ষ ও নিরীহ এলাকাবাসীদের। অবৈধ অস্ত্রের গুলি, ককটেল ও দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে আহত হয় ৫শতাধিক মানুষ।
নিহত হয় দুই জন। একজন নিহত হবার ঘটনায় একটি খুনের মামলা রুজু হলেও অপর খুনের মামলা রুজু হয়নি। জারী রয়েছে ১৪৪ ধারা। পাহাড়ায় রয়েছে ৮০জন দাঙ্গা পুলিশ সদস্য। তারপরও এলাকায় থম থমে অবস্থা বিরাজ করছে। যে কোন সময়ই বড় ধরনের সহিংসতায় অসংখ্য প্রাণহানীর ঘটনা ঘটে যেতে পারে বলে আশংকা করছেন অভিজ্ঞজন।
এলাকাবাসীর প্রশ্ন আওয়ামী লীগের দুই গ্র“পের মধ্যে আধিপত্যের লড়াইয়ে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়। কবে শান্ত হবে এই অশান্ত জনপদ।