নিজস্ব প্রতিবেদক
রাষ্ট্রের অন্যান্য বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানকে বিচার বিভাগকে সহযোগিতা করার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। তিনি বলেন, রাষ্ট্রের প্রতিটি সংস্থা অন্য সংস্থার ওপর আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। শুধু সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানগুলোই নয়, রাষ্ট্রের বিভাগগুলোও এ প্রতিযোগিতার বাইরে নেই। কেবলমাত্র বিচার বিভাগই এর ব্যতিক্রম। যারা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকে, তাদের মধ্যে এ আধিপত্য বিস্তারের প্রবণতা বেশি মাত্রায় প্রতীয়মান হয়। কিন্তু বিচার বিভাগ কখনো এ প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি; করবেও না।
শনিবার জাতীয় বিচার বিভাগীয় সম্মেলন ২০১৬-এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সম্বলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘গণতন্ত্রকে বিকশিত করার জন্য গণতান্ত্রিক সরকারের প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক সরকারের স্থলে অগণতান্ত্রিক সরকার কোনা সমাধান নয়। আর গণতান্ত্রিক সরকার যদি ৫ বছর দেশ পরিচালনা করতে পারে, তাহলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে না পারা হবে রাজনীতিবিদদের দেউলিয়াপনা।’
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত বিচার বিভাগীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা।
অনুষ্ঠানে বিচার বিভাগীয় ‘তথ্য বাতায়ন’ উদ্বোধন করা হয়।
সম্মেলনে আরও বক্তব্য রাখেন- ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ, সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরী, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্টার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম প্রমুখ।
এ ছাড়া সম্মেলন সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের শতাধিক বিচারপতি এবং নিন্ম আদালতের প্রায় দেড় হাজার বিচারক উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে কার্যসূচিতে বিশেষ অতিথি হিসেবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নাম থাকলেও অসুস্থতাজনিত কারণে তিনি উপস্থিত ছিলেন না বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের দ্বিতীয় ও শেষ দিনের অনুষ্ঠান রোববার সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হবে।
বিচার বিভাগের সঙ্গে রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভারসাম্য রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করে সম্মেলনে প্রধান বিচারপপতি বলেন, ‘আমরা বরং সব সময় রাষ্ট্রের বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্ঠা করেছি। আর এর জন্য শাসনতন্ত্র আমাদের ওপর যতটুকু দায়িত্ব ও ক্ষমতা অর্পণ করেছে, আমরা শুধু ততটুকুই করব। আমি আশা করব, রাষ্ট্রের অন্যান্য বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানও বিচার বিভাগকে সেভাবেই সহযোগিতা করবে।’
তত্ত্ববাধয়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘একটি গণতান্ত্রিক সরকার ৫ বছর দেশ পরিচালনার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি কার্যকর হত। আর এই সরকারের প্রধান হতেন একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি। তখন বিচারপতিদের নিয়ে রাজনীতি শুরু হয়ে যেত। এ জন্য বিচার বিভাগকে নিরপেক্ষ ও স্বাধীন রাখতে সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে রায় দিয়েছে। কারণ তত্ত্বাধায়ক সরকারের প্রধান হিসাবে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি নিরপেক্ষ কি-না, সে বিষয়ে নানা আলোচনা হত। আর তিনি যদি নিরপেক্ষ না হন, তাহলে তিনি বিচারপতি থাকাকালে যেসব রায় প্রদান করেছেন, সেগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের পর সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন রাজনীতিবিদরা দিতে পারে কিনা, সেটা সময়ই বলে দেবে।’
সম্মেলনে বিচার বিভাগের বিভিন্ন ধরনের সংকট তুলে ধরে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও গত বছরগুলোর তুলনায় মামলা নিষ্পত্তি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ বিচারক সংকটের কারণে বিভিন্ন সময় উচ্চ আদালতে বেঞ্চ গঠনে আমাকে হিমশিম খেতে হয়। এর মধ্যে ২০১৭ সালে ৭ জন বিচারপতি অবসর গ্রহণ যাবেন। ফলে বেঞ্চ গঠনে জটিলতা আরও প্রকট হবে। এ জন্য চলতি বছরের আগস্টে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর উভয় পক্ষের সন্মতিক্রমে হাইকোর্ট বিভাগে ৮ জন অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগের জন্য সরকারকে সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু চার মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও এ নিয়োগ প্রক্রিয়া আলোর মুখ দেখেনি।’