একাত্তরলাইভডেস্ক: পুরান ঢাকায় চার শত বছরের ইতিহাস ঐতিহ্যের স্বাক্ষর বহন করে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য পুরনো ভবন। যার প্রতিটিই একেকটি মৃত্যুর ফাঁদ। এলাকাবাসীর মাঝে এ বিষয়ে নেই কোনো শঙ্কা নেই বললেই চলে। তারা এ শঙ্কাকে স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিয়ে পরিত্যক্ত ভবনগুলোতে নির্দ্বিধায় বসবাস করে যাচ্ছেন। বেশির ভাগই পারিবারিক বিরোধ এবং আর্থিক অসামর্থের কারণে পুরনো ভবন ভেঙ্গে গড়তে পারছেন না নতুন ভবন। ঝুঁকিপূর্ণ, অননুমোদিত এবং মান্ধাতার আমলের জরাজীর্ণ ভবনগুলো এখন মৃত্যুফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতিহাস-ঐতিহ্যের নগরী ঢাকায় জনসংখ্যা বেড়েছে অনেক। বলতে গেলে ঠাঁই নেই। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাসস্থানগুলো সেভাবে সংস্কার করা হয়নি।আজ যেটাকে পুরান ঢাকা বলা হয় সেটাই হচ্ছে আসল ঢাকা। পর্যায়ক্রমে ঢাকার বিস্তৃতি বেড়েছে। আধুনিকায়ন হয়েছে। কিন্তু পুরান ঢাকার মান্ধাতার আমলের ভবনগুলোর কোনো পরিবর্তন হয়নি। ফলে মৃত্যু আর আতঙ্ক নিয়ে লাখো মানুষ গাদাগাদি করে দীর্ঘদিন ধরেই এই মৃত্যুফাঁদে বসবাস করে যাচ্ছে। শাঁখারি বাজারের জনাজীর্ণ একটি বাড়িতে বসবাস করছেন মনিকা মল্লিক। তিনি বলেন, ‘আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় নতুন করে বাড়ি নির্মাণ করতে পারছি না। জেনে বুঝেও জরাজীর্ণ ভবনে বাস করছি। তাছাড়া পুরাতন ভবন পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রেখেছে বলে সংস্কার করা হয়ে ওঠেনি।’ শাঁখারিবাজারের কৈলাশ ঘোষ লেনের ১৬ নম্বর বাড়িটি প্রায় ২০০-২৫০ বছরের পুরনো। এর একাংশের মালিক মৃত ভোলানাথ সুর স্ত্রী প্রায় ৪০ বছর ধরে এখানে বাস করছেন। কিন্তু বর্তমানে চাচা ও ভাইপোদের মধ্যে বাড়ির জমি নিয়ে প্রায়ই মারামারি হয়। এছাড়া বাড়িটি নতুন করে তৈরি করার মতো সামর্থ্য তাদের নেই। তাইঝুঁকি নিয়েই বসবাস করছেন তারা। পুরান ঢাকায় এ রকম অনেকগুলো ভবন আছে যেগুলোর জমি নিয়ে বিরোধ ও আর্থিক অসামর্থের কারণে ভাঙতে পারছেন না। নির্মাণ করতে পারছেন না নতুন ভবন। সরজমিন ঘুরে দেখা যায়, শাঁখারিবাজার, তাঁতিবাজার, টিপু সুলতান রোড, আহছান উল্লাহ রোড, এমনকি বাবুবাজার পুলিশ ফাঁড়ির বাড়ি, চকবাজার, সাতরওজা সূত্রাপুর, ফরাশগঞ্জ, নবাবগঞ্জ রোড, লালবাগ, হাজারীবাগ, বংশাল, কোতোয়ালি শ্যামপুর, কামরাঙ্গীরচর ও কদমতলী এলাকায় জরাজীর্ণ ও পরিত্যক্ত ভবনগুলোয় মৃত্যু আতঙ্ক নিয়ে বসবাস করছে অগণিত পরিবার। তবে এ বিষয়ে তাদের মাঝে তেমন শঙ্কা দেখা যায় না। স্বাভাবিকভাবেই বসবাস করছেন তারা। অনেকে আবার পুরানো ভবনগুলোকে ইতিহাস ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবেও রেখে দিয়েছেন। বসবাস করছেন নিশ্চিন্তে। জানা গেছে, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (ডিসিসি) জিওডেসেক কনসালট্যান্টস অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তালিকা করে পুরান ঢাকার ৫৭৩টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে। এর মধ্যে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ১৪৫টিকে এখনই ভেঙে ফেলা উচিত বলে মন্তব্য করেছে তালিকা প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠানটি। যার মধ্যে রয়েছে ২১টি হাজারীবাগে, ৭৩টি লালবাগে ও ৯১টি শাঁখারিবাজারে। রাজউক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) তথ্য অনুযায়ী রাজধানীতে ৫৭৩টি ভবন হেরিটেজ ও ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে ৩২১টি অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাকি ২৫২টি হেরিটেজ ভবন তালিকাভুক্ত রয়েছে। ভূতাত্ত্বিকদের গবেষণায় ঢাকা শহর ভূমিকম্পের জন্য ভয়ানক ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে পুরান ঢাকা। জরাজীর্ণ এসব ভবন প্রতি মুহূর্তে জানান দিচ্ছে যেকোনো সময় আসতে পারে বিপদ, ঘটতে পারে বড় কোনো দুর্ঘটনা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো জানায়, ঢাকার প্রায় সাড়ে তিন লাখ ভবনের ৪০ শতাংশ ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ। আর এসব ভবনের বেশির ভাগই পুরান ঢাকায়। জাতিসংঘের এক জরিপে জানা গেছে, বিশ্বের ভূতাত্ত্বিক ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি শহরের মধ্যে একটি হলো পুরান ঢাকা। ঝুঁকিপূর্ণ ও জরাজীর্ণ ভবন অপসারণে উদ্যোগ নেওয়া না হলে বড় ধরনের প্রাণহানিসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও আশঙ্ক প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সরকার এক প্রজ্ঞাপন জারি করে শাঁখারিবাজার, ফরাশগঞ্জ, সূত্রাপুর ও মিন্টো রোড এলাকাকে সংরক্ষিত হিসেবে ঘোষণা করে। প্রজ্ঞাপনে ওইসব এলাকার পুরনো ভবনগুলো সংরক্ষণের পাশাপাশি প্রয়োজনে অপসারণ এবং সংস্কারের কথা বলা হয়। ২০০৪ সালের ৯ জুন শাঁখারিবাজারে এরকমই একটি ভবন ধসে মারা গিয়েছিল ১৯ জন। সরকার বিভিন্ন সময় পুরাতন ভবনগুলো নতুন করে তৈরি করতে উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়ন হয় না। কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার পর বেড়ে যায় তৎপরতা। গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। আলোচনা-সমালোচনায় সরব হয়ে ওঠে দেশ। তার পর সব আবার আগের মতই থাকে। বড় ধরনের দূর্ঘটনা ঘটার আগেই পুরান ঢাকার এসব মৃত্যুফাঁদের জরাজীর্ণ ভবনের ব্যাপারে অতিদ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া সময়ের দাবি।
মৃত্যুফাঁদে ঝুঁকি নিয়ে বাস

November 11, 2016