মাশরাফি যেন ফিনিক্স পাখি। ধ্বংসস্তুপ থেকে আপন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে বার বার উড়ে চলেন অসীম নীলাকাশে। যার উড়ে চলায় সৃষ্টি হয় ইতিহাস, গড়ে ওঠে গৌরবগাথা।সেই মাশরাফিই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আজ ১৫ বছর পূর্ণ করলেন। এবং এই অনন্য গৌরবে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম ম্যাশ! তিনিই একমাত্র সক্রিয় ক্রিকেটার, যিনি দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৫ বছর ধরে লড়ে যাচ্ছেন।৮ নভেম্বর, ২০০১ সাল। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ তখন সদ্যজাত শিশু। সেদিন নিজেদের ষষ্ঠ টেস্ট খেলতে নামে বাংলাদেশ। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেই টেস্টেই টগবগে এক তরুণকে মাঠে নামায় বাংলাদেশ। সেই তরুণ ছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। সেই থেকে ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ চলেছেন দুরন্ত গতিতে।‘দুরন্ত গতি’ শব্দদ্বয় চয়ন কি ঠিক হলো? মাশরাফির গতিকে যে কতোবার বাধাগ্রস্থ করার চেষ্টা করেছে ইনজুরির কালো থাবা! হ্যাঁ, ওই ‘চেষ্টা’ পর্যন্তই; অদম্য মাশরাফিকে রুখে দেওয়ার শক্তি ছিল না ইনজুরির। মাশরাফি হোঁচট খেয়েছেন, কিন্তু পড়ে যাননি। বরঞ্চ ইনজুরিকেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে ফিরেছেন লড়াইয়ের ময়দানে। আর তাই সেই ২০০১ থেকে আজ ২০১৬ পর্যন্ত বল হাতে দৌড়াচ্ছেন মাশরাফি, কখনো বা ঝড় তুলছেন ব্যাটে। সাতবার দুই হাঁটুতে অস্ত্রোপচারের পরও মাশরাফি ক্রিকেট খেলছেন- কারো কারো কাছে স্রেফ রূপকথা! কিন্তু মাশরাফি মানেই রূপকথার বাস্তব প্রতিফলন।বাংলাদেশের একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে মাঠে সক্রিয় থেকে ১৫ বছর পার করেছেন মাশরাফি। তার আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটেছিল মোহাম্মদ শরীফের। কিন্তু শরীফ এখন ‘আউট অব দ্য ট্র্যাক’। যদিও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানাননি, কিন্তু গত প্রায় ৯ বছর ধরে শরীফকে দেখা যায়নি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ময়দানে। সে হিসেবে মাশরাফিই এক ও অদ্বিতীয়।মাশরাফি শুধু খেলার জন্যই খেলে যাচ্ছেন না। গত দুই বছরে বাংলাদেশ জাতীয় দলকে বদলে দেওয়ার রূপকার মাশরাফি দলের সেরা পারফরমারদের একজনও। ১৫ বছর আগে মাশরাফি দলের জন্য যতটা অপরিহার্য ছিলেন, এখন তারচেয়ে অনেকগুণ বেশি অপরিহার্য। এখন বাংলাদেশ মানেই মাশরাফি অবধারিত! জাতীয় ক্রিকেট দল, ক্রিকেট বোর্ড কিংবা আমজনতা, সবার কাছে বিনাবাক্যে মাশরাফি সমানভাবে গ্রহণযোগ্য, তুমুল জনপ্রিয়।কোনো এক জিয়নকাঠির ছোঁয়ায় বাংলাদেশ দলকে বদলে দেওয়া মাশরাফি ক্রমাগত লড়াই করে যাচ্ছেন। সে লড়াই শুধু মাঠে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নয়, নিজের দুই হাঁটুর সাথেও। প্রতিদিন ঘুম ভেঙ্গে দুই হাঁটু থেকে পচা রক্ত বের করতে হয় সিরিঞ্জ দিয়ে! দিনের পর দিন এ কাজ করে চলেছেন মাশরাফি। ইনজুরির ভয়ে অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ, ব্রেট লি, শেন বন্ড, শন টেইট- কতো বাঘা বাঘা পেস বোলার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে অবেলায় বিদায় জানিয়েছেন। কিন্তু মাশরাফি অনন্য, অসাধারণতার চাদরে মোড়া। যার লড়াইয়ের গল্প শুনে বিস্ময়ে আর শ্রদ্ধায় অবনত হয় ক্রিকেটবিশ্ব; যাঁর লড়াই প্রেরণা জোগায় জীবনযুদ্ধে লড়ে যাওয়া ক্লান্ত, শ্রান্ত কতো-শত মানুষকে।পনেরো পেরিয়ে মাশরাফি তাই সন্তুষ্টির কথা বলেন, ‘সত্যি বলতে খুব ভালো লাগছে। আমি কী করতে পেরেছি এজন্য নয়, বরং বাংলাদেশ দলের একজন হিসেবে ১৫ বছর পার করলাম, এটা ভেবেই।’ ইনজুরির বিষাক্ততায় মাশরাফি যদি নীল না হতেন, তবে কোথায় থাকতো তার ক্যারিয়ারের পরিসংখ্যান, এটা নিয়ে আক্ষেপ আছে সবারই। কিন্তু মাশরাফি আক্ষেপের চেয়ে প্রাপ্তিটাকেই বড় করে দেখেন, ‘ইনজুরি না থাকলে পরিসংখ্যান আরো সমৃদ্ধ হতে পারতো। তবে সেই আক্ষেপের চেয়ে ভালোলাগাটা বেশি, যখন ভাবি এতো সমস্যার মাঝেও খেলতে পারছি।’ক্রিকেটার হওয়ার ইচ্ছা ছিল না মাশরাফির! মনের আনন্দে সব খেলাই খেলতেন। কখনো ফুটবল নিয়ে মাঠে দৌড় তো কখনো ক্রিকেট নিয়ে মাতামাতি। মজা পেতেন, তাই খেলতেন। খুলনা মোহামেডান ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মাশরাফির নানা। এক ম্যাচে প্লেয়ার সংকট থাকায় নানা জোর করে মাশরাফিকে মাঠে নামিয়ে দিলেন। তারপর তো ইতিহাস! ওই ম্যাচেই ২৪ রান দিয়ে নিলেন ৬ উইকেট! এরপর শুধু এগিয়ে যাওয়া!খুলনা অনুর্ধ্ব-১৭ দলে সুযোগ পেয়ে গেলেন। ছয়টি বিভাগের মধ্যকার টুর্নামেন্টে ৬ ম্যাচের ৪ ম্যাচেই ম্যান অব দ্য ম্যাচ মাশরাফি! ডাক পড়ল বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৭ দলে। সেখান থেকে অনুর্ধ্ব-১৯ দল, পরে ‘এ’ দল। ভারত সফরে ‘এ’ দলের হয়ে ৪ ম্যাচে নিলেন ১৬ উইকেট! এরপর তো সোজা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নামিয়ে দেওয়া হয় মাশরাফিকে। সেই যে শুরু, আজ অবধি বাংলাদেশের সবচেয়ে নির্ভরতার নাম মাশরাফি।বছর দুয়েক আগেও বাংলাদেশ যেন ছিল ‘জিততে না চাওয়া’ এক দল! সেই দলকেই কোনো এক জাদুমন্ত্রের বলে জয়ের জন্য আগ্রাসী, ক্ষুধার্ত করে তুললেন মাশরাফি। যার স্পর্শে আত্মবিশ্বাসহীন দল প্রবল আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান হয়ে ওঠে, ফর্ম হারিয়ে লড়ে যাওয়া ব্যাটসম্যান কিংবা বোলার ফিরে পায় দুর্দান্ত ফর্ম। সোনা ফলিয়ে যাওয়া ‘জাদুকর’ মাশরাফির পথচলায় আরো সমৃদ্ধ হবে বাংলাদেশের ক্রিকেট, এমনটা কে না চায়!
মাশরাফির গৌরবের ১৫ বছর
November 8, 2016