অনলাইন ডেস্ক: বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দক্ষতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং তদারকির মান নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় এই বিশাল বাজেট বাস্তবায়ন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেবে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। বৃহস্পতিবার বিকালে ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটের উপর এফবিসিসিআই’র তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, বাজেট বাস্তবায়নে অর্থায়ন ও অর্থ ব্যয় সঠিকভাবে করতে না পারায় প্রতিবছরই বাজেট সংশোধন করতে হয়। এতে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের উপর যাতে নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন।
এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৭.৪ শতাংশ এবং সম্ভাব্য মুল্যস্ফীতি ৫.৫ শতাংশ নির্ধারণ করে অর্থমন্ত্রী আগামী ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণা করেছেন। এটি বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে ৯ম বাজেট এবং মাননীয় অর্থমন্ত্রীর ১১তম বাজেট। এ বাজেটের উপর আমরা তাৎক্ষনিকভাবে এফবিসিসিআই’র পর্যবেক্ষণ তুলে ধরছি। পরবর্তীতে বাজেট ডকুমেন্টস, অর্থ বিল পর্যালোচনা এবং এফবিসিসিআই-এর বাজেট এক্সপার্ট ও ব্যবসায়ী নেতাদের সাথে আলোচনা করে আগামী জুন ৩ প্রাথমিক মতামত তুলে ধরব। পরবর্তীতে বিষদ পর্যালোচনা এবং এফবিসিসিআই-এর সদস্যভুক্ত চেম্বার ও এসোসিয়েশনের মতামতের আলোকে এফবিসিসিআই-এর বিস্তারিত মতামত উপস্থাপন করা হবে।
এফবিসিসিআইয়ের বাজেট বিষয়ক প্রতিক্রিয়া
২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার। যা গত অর্থ বছরের ঘোষিত বাজেটের (৩ লক্ষ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা) তুলনায় ১৭.৫২% বেশি এবং সংশোধিত বাজেটের তুলনায় (৩ লক্ষ ১৭ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা) ২৬.২০% বেশি।
প্রস্তাবিত বাজেটে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, দারিদ্র বিমোচন, মানব সম্পদ উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী প্রভৃতি খাতে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী আওতায় সুবিধাভোগীদের সংখ্যা এবং মাসিক ভাতার হার বৃদ্ধি করা হয়েছে। সেইসাথে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বছরে দুটি উৎসব ভাতার প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থ বছরের মত আগামী বাজেটেও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অর্থ বরাদ্দের জন্য এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ অন্যান্য ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়ে বাজেটে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে তা নিঃসন্দেহে বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থান প্রক্রিয়া গতিশীল করবে। তবে এসকল অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশীপ বা পিপিপি ব্যবস্থা কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়ার জন্য আমরা সরকারকে আহ্বান জানায়।
নতুন বাজেটে ঘাটতি দাড়াচ্ছে প্রায় ১ লক্ষ ১২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা যা জিডিপির ৫%। চলতি অর্থ বছরের বাজেট ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৭ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য সরকারের ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়ার প্রবণতা বাড়তে পারে। অভ্যন্তরীণ ঋণ ব্যবস্থা থেকে ৬০ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা (ব্যাংক ব্যবস্থা ২৮ হাজার ২০৩ কোটি টাকা এবং জাতীয় সঞ্চয় প্রকল্প থেকে ৩০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা) নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্যাংক খাতের উপর নির্ভলশীলতা উৎপাদনশীল খাততে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
প্রস্তাবিত বাজেটে মোট রাজস্ব প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লক্ষ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা যা চলতি বাজেটের লক্ষমাত্রার (২ লক্ষ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা) তুলনায় ১৮.৬৩%। অন্যদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নিয়ন্ত্রিত করের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লক্ষ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা যা গত বছরের লক্ষ্যমাত্রা (২ লক্ষ ৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকা) তুলনায় ২২.০৭% বেশি।
প্রস্তাবিত বাজেটে শুধুমাত্র ভ্যাট খাতেই রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯১ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা যা চলতি বছরে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা (৭২ হাজার ৭৬৪ কোটি) তুলনায় ২৫.৪২% বেশি। এছাড়া আয়কর খাতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৫ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা যা চলতি বছরের (৭১ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা) তুলনায় ১৮.৪০% বেশি এবং আমদানী শুল্ক খাতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে ৩০ হাজার ২৩ কোটি টাকা যা চলতি বছরের (২২ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা) তুলনায় ৩৩.৭৩% বেশি ।
সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী ১লা জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হচ্ছে। ভ্যাটের বিষয়টি নিয়ে ব্যবসায়ী মহল সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। নতুন ভ্যাট আইন বাস্তায়নের পূর্বে আইনের কতিপয় বিষয় সংশোধনের জন্য আমরা সরকারের কাছে জোর দাবী জানিয়েছিলাম। কিন্তু বাজেটে সম্পূর্ণ না হলেও কিছুটা এসবের প্রতিফলন আমরা লক্ষ্য করেছি।
বাজেটে কতিপয় পণ্যের ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি সম্পূরক শুল্ক অব্যাহত রাখা হয়েছে-যা দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেবে। প্রস্তাবিত বাজেটে টার্নওভার করের সীমা ১ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে টার্নওভার ট্যাক্স ৩% থেকে বৃদ্ধি করে ৪% করা হয়েছে। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে টার্নওভার ট্যাক্স ৩% অপরিবর্তিত রেখে টার্নওভার করের সীমা ৫ কোটি টাকা হওয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।
এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, কোন ব্যক্তির অর্থনৈতিক কার্যক্রমের বার্ষিক টার্নওভার সীমা ৩৬ লক্ষ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে বর্তমানে যা ৩০ লক্ষ টাকা নির্ধারিত রয়েছে। ক্ষুদ্র, গ্রামীণ উদ্যোগ, কুটির শিল্প ইত্যাদি প্রান্তিক খাতের বিকাশে এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা দোকানদারদের হিসাব সংরক্ষণের সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করে অব্যাহতি এ সীমা ৫০ লক্ষ টাকায় উন্নীত করার জন্য পুনরায় প্রস্তাব করে এফবিসিসিআই।
ব্যবসায়ীদের সংগঠনটি দাবি করে, যদিও আমরা হ্রাসকৃত হারে বিভিন্ন স্তরে মূসক হার নির্ধারণ করা প্রস্তাব করেছিলাম কিন্তু বাজেটে হ্রাসকৃত হারে ভ্যাটের পরিবর্তে সিঙ্গেল রেট ১৫% ভ্যাট নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে দেশের শিল্পখাত বিশেষ করে এসএমই খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মূল্যষ্ফীতি বৃদ্ধি পাবে।
বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা বৃদ্ধির করার আমাদের প্রস্তাব থাকা সত্ত্বেও এ সীমা ২ লাখ ৫০ হাজার টাকায় অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি, জীবন যাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, জনগনের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে এ সীমা ৩ লক্ষ ২৫ হাজার টাকায় উন্নীত করার জন্য আবারও প্রস্তাব রাখছি।