বিদ্রোহীদের জয়ের পেছনে নেতায় নেতায় দ্বন্দ্ব

বিশেষ সংবাদদাতা
আওয়ামী লীগের তৃণমূলে দলীয় কোন্দল ও নেতায় নেতায় দ্বন্দ্ব আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জেলা পরিষদ নির্বাচনের ফলাফলে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের দাপুটে জয় সেটাই প্রমাণ করেছে। দলের মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীদের পরাজয়ের পেছনে অনেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা রয়েছেন বলে জানা গেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, তৃণমূলের কোন্দল-দ্বন্দ্বের ফসলই হচ্ছে এবার বিদ্রোহীদের দাপুটে জয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৩০ জেলায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর বাইরে ৫০ জন বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। গত বুধবার অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদ নির্বাচনে ১২ জেলায় বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। যে ২১ জেলায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন সেখানে তাদের অনেক বেগ পেতে হয়েছে। এসব জেলায় বিদ্রোহী প্রার্থীদের ম্যানেজ করতে না পারলে অধিকাংশ জেলা বিদ্রোহীদের দখলে চলে যেত বলে সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসী মনে করছেন।
বিদ্রোহী প্রার্থীদের জয় ও তৃণমূলে দ্বন্দ্ব-গ্রুপিং এবং বিদ্রোহী প্রার্থীদের শাস্তি প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রাজ্জাক বলেন, মনোনয়ন যাদের দেয়া হয়েছে তাদের পক্ষে কাজ না করে অনেকে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছেন। এটা তারা সঠিক কাজ করেন নি। তারা দলীয় সিদ্ধান্তকে অমান্য করেছেন। তাদের কম বেশি শাস্তির আওতায় আনা হবে। তবে এ ব্যাপারে দলে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
দলে গ্রপিং সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ অনেক বড় দল। তৃণমূল পর্যায়ে এ দলে অনেক নেতা আছেন। ফলে গ্রপিং থাকাটা অস্বাভাবিক নয়’।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের অনেকেরই ভরাডুবি হতো। প্রতি জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যারা ক্ষমতার কাছাকাছি আছেন তারা তৃণমূলের নেতাদের পাত্তাই দেন না। বিশেষ করে জেলা, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ অন্য নেতাদের সঙ্গে সংসদ সদস্যদের দূরত্ব অনেক বেশি। এই সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রত্যেকেই এক একটি গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও পৌরসভায় আওয়ামী লীগের ৪ থেকে ৫টি গ্রুপ রয়েছে।
আওয়ামী লীগের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ইতোপূর্বে যারা জেলা পরিষদের প্রশাসক পদে ছিলেন তারা অনেকেই হেরে গেছেন। তাদের হারার পেছনে দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টিই বেশি দায়ী। তিনি বলেন, অনেক নেতা আছেন ক্ষমতা পেলেই তার পছন্দের গুটিকয়েক ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে গ্রুপ করে ফেলেন। যা এক সময় কোনো রাজনৈতিক নেতার জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।  তিনি আরও বলেন, স্থানীয় সরকারে বিভিন্ন জেলায় বিএনপির যেসব প্রতিনিধি আছেন জেলা পরিষদ নির্বাচনে তারা অধিকাংশই দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে ভোট দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগ যাদের নাম প্রস্তাব করেছিলেন তারা অনেকেই দলীয় মনোনয়ন পাননি। প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা ভালো জানেন কার জনপ্রিয়তা কেমন। এ ক্ষেত্রে তাদের মতামতের তোয়াক্কা না করেই কেন্দ্রীয় নেতাদের মতামতের ভিত্তিতে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। ফলে তৃণমূলের অনেক নেতাই চলে গেছেন বিদ্রোহীদের পক্ষে।
যেমন জামালপুরের ফারুক আহমেদ চৌধুরীকে প্রার্থী করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। কিন্তু তাদের প্রস্তাবকে গ্রাহ্য না করে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেয় এইচ আর জাহিদ আনোয়ারকে। ফলে জেলা আওয়ামী লীগের অনেক নেতা দলীয় মনোনীত প্রার্থীকে সমর্থন না দিয়ে চলে যান বিদ্রোহী প্রার্থী ফারুক আহমেদ চৌধুরীর পক্ষে। এ জেলায় ফারুক আহমেদ চৌধুরী বিজয়ী হন। এখানে বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম।
অনুরূপভাবে অন্য যেসব জেলায় বিদ্রোহী প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে সেখানেও একই অবস্থা ছিল।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রাজ্জাক জেলা পরিষদ নির্বাচনের মূল্যায়ন সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করার অংশ হিসেবে আমরা স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করছি। জেলা পরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা তৃণমূলকে শক্তিশালী করছি। তৃণমূলকেও আমরা উন্নয়নের সঙ্গী করতে চাই’।