ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কক্সবাজার-৪ (টেকনাফ-উখিয়া) আসনের আলোচিত-সমালোচিত সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদিকে দুর্নীতির মামলায় তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার পর নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। সে বিতর্ক জাতীয় সংসদে আব্দুর রহমান বদির সদস্য পদ থাকা না থাকা নিয়ে।
রায় ঘোষণার পরই বদি সংসদ সদস্য পদ হারিয়েছেন-এমন অভিমত দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক আইনজীবীর। তবে সরকারপন্থী সিনিয়র আইনজীবীরা এই বক্তব্য মানতে নারাজ। তাদের মতে, চূড়ান্তভাবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হলেই কেবল বদির সংসদ সদস্য পদ বাতিলের প্রশ্ন আসবে।
বদির বিরুদ্ধে দুদক মামলাটি দায়ের করেছিল দুই বছর আগে। মামলার অভিযোগ ছিল বদির অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপন করার বিষয়ে। অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলার রায়ে খালাস পেলেও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে বদিকে তিন বছর কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে বুধবার (২ নভেম্বর)।
ক্ষমতাসীন দলের একজন সংসদ সদস্যকে দুর্নীতির দায়ে এভাবে শাস্তি দেওয়ার ঘটনা বিরল। অনেক আইনজীবীই বলছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে আগে এমনটি হয়নি।
রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, ‘দুর্নীতিবাজ যতই প্রভাবশালী হোক, তাকে আইনের আওতায় আসতে হবে।’
দুদকের অধিকাংশ মামলায় অভিযুক্তরা ছাড়া পেয়ে যায়, এমন সমালোচনার মধ্যে একজন সংসদ সদস্যকে দোষী প্রমাণ করে শাস্তি নিশ্চিত করার বিষয়টিকে বড় একটি সাফল্য হিসেবেই দেখছে দুদক। এ সংস্থার আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেছেন, ‘কাদের দুর্বলতার কারণে অভিযুক্তরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে তা খতিয়ে দেখা দরকার।’
অবশ্য রায় ঘোষণার পর সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে আব্দুর রহমান বদির সংসদ সদস্য পদে থাকার প্রশ্নটি। এ ক্ষেত্রে আইনজীবীদের বক্তব্যে ভিন্নতা পাওয়া গেছে। কারণ, সংবিধান অনুযায়ী একজন ব্যক্তি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে এবং দণ্ড ভোগ করার পর অন্তত পাঁচ বছর অতিবাহিত না হলে তিনি সংসদ সদস্য পদে অযোগ্য হবেন।
এই প্রেক্ষাপটে দুদক কৌঁসুলি খুরশীদ আলম খানের বক্তব্য, রায় ঘোষণার পর বদি আর সংসদ সদস্য নেই। খুরশীদ আলম বলেছেন, ‘সংবিধানের ৬৬ (২) (ঘ) অনুচ্ছেদে এ বিষয়ে স্পষ্ট বলা আছে, নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে এবং তার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকলে তিনি সংসদ সদস্য হওয়ার থাকার অযোগ্য হবেন। সুতরাং রায় ঘোষণার পর থেকে তিনি (বদি) আর এখন সংসদ সদস্য নেই।’
এ বিষয়ে একই ধরনের বক্তব্য সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেনেরও। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান পদে থাকা এই আইনজীবী বলেছেন, ‘বদি আপিল করলেও তার সংসদ সদস্যপদ থাকার কারণ নেই। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী তার পদ থাকার কথা না। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কয়েকজন চেয়ারম্যান প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিলের পর আমরা হাইকোর্টে গিয়ে পক্ষে রায় পাইনি। কারণ, আদালত বলেছে তারা সাজাপ্রাপ্ত।’
দুদক কৌঁসুলি খুরশীদ আলম খান ও খন্দকার মাহবুব হোসেনের বক্তব্যের সঙ্গে অবশ্য দ্বিমত পোষণ করেছেন আওয়ামীপন্থী জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা। তারা মনে করেন আইনের মাধ্যমে সংসদ সদস্য পদের বিষয়টি নিষ্পত্তি হতে হলে আপিল বিভাগের রায়ে চূড়ান্তভাবে দণ্ডিত হতে হবে বদিকে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির বর্তমান সভাপতি ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন এ বিষয়ে বলেছেন, ‘এটা আপিলের বিষয় আছে। আপিলে যদি আবার স্থগিত হয়ে যায়, সর্বশেষ আইনগত যুদ্ধ যেটা আমরা বলি অর্থাৎ আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত এটা কিছু করা যাবে না।’
তবে আপিলের আগেই নৈতিকতার প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বদি নিজে অথবা তার দল ব্যবস্থা নিতে পারে উল্লেখ করে জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী বলেছেন, ‘নৈতিকতার ব্যাপার আছে এখানে। নৈতিকতার কারণে এর ফয়সালা দুভাবে হতে পারে, সে নিজে পদত্যাগ করতে পারে, আবার তাকে দল থেকে পদত্যাগের কথা বলা হতে পারে। কিন্তু আইনগত দিক থেকে বিবেচনা করলে এখানে আপিলের সুযোগ আছে এবং সর্বশেষ চূড়ান্তভাবে সাজা বহাল না থাকা পর্যন্ত তার সংসদ সদস্য পদ থাকবে।’
নৈতিকতার প্রশ্নে এর আগে বর্তমান মন্ত্রিপরিষদের একাধিক মন্ত্রীর ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। জামায়াত নেতা ও একাত্তরের যুদ্ধপরাধী মীর কাসেম আলীর আপিলের রায়ের আগে প্রধান বিচারপতি ও বিচার বিভাগ নিয়ে অবমাননাকর বক্তব্য দিয়ে দণ্ডিত হয়েছিলেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ চলতি বছর ২৭ মার্চ তাদের ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে ৭ দিনের কারাদণ্ড দেন। তখনো অনেক সংবিধান বিশেষজ্ঞ দুই মন্ত্রীর পদে থাকা নিয়ে নৈতিকতার প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। তবে দণ্ডিত হওয়ার ছয় মাসের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও তারা মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব পালন করছেন।
একইভাবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া দুর্নীতির মামলায় নিম্ন আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ১৩ বছর কারাদণ্ড পেয়েছিলেন। হাইকোর্ট সেই সাজার রায় বাতিল করেছিলেন। তবে হাইকোর্টের সেই রায় আপিল বিভাগ বাতিল করে দেন। তাই তার পুরোনো সাজা বহাল হয়। তবে তিনি মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তার ক্ষেত্রে আপিল প্রেক্ষিতে দণ্ড স্থগিত থাকার যুক্তি দিয়েছেন সরকারপক্ষের আইনজীবীরা।
একই রকম যুক্তি তারা দিচ্ছেন বদির ক্ষেত্রেও। বদি সবেমাত্র দণ্ডিত হলেন, এরপর আপিল করলে সেই আপিলের রায়ের পরই তার সংসদ সদস্য পদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। এ বিষয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, ‘এই রায়ই চূড়ান্ত নয়। তিনি আপিল বিভাগ কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হবে না।’
নিম্ন আদালতে বদির আইনজীবী হিসেবে লড়াই করা নাসরিন সিদ্দিকী লিনা এরই মধ্যে আপিলের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘এই মামলায় এফআইআর-এর সঙ্গে অভিযোগপত্রের তথ্যে গরমিল রয়েছে। এই রায়ে আমরা সংক্ষুব্ধ ও আমরা অবশ্যই উচ্চ আদালতে আপিল করব।’
মামলার বিবরণী :
দুদকের উপপরিচালক মো. আব্দুস সোবহান ২০১৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার রমনা থানায় সাংসদ বদির বিরুদ্ধে এ মামলা করেন। এজাহারে বলা হয়, এমপি বদি আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পদ অর্জনের পাশাপাশি অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদের বৈধতা দেখাতে কম মূল্যে সম্পদ কিনে বেশি মূল্যে বিক্রির মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন।
এই মামলায় দুদকের উপপরিচালক মনজিল মোরসেদ ২০১৫ সালের ৭ মে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতে বদির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন। অভিযোগপত্রে বদির ৬ কোটি ৩৩ লাখ ৯৪২ টাকার অবৈধ সম্পদের তথ্য তুলে ধরা হয়। বলা হয়, তিনি দুদকের কাছে ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৫৩ হাজার ২৭ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন।
মামলা দায়েরের পর ২০১৪ সালের ১২ অক্টোবর গ্রেফতার হয়েছিলেন বদি। পরে তিনি হাই কোর্টের অন্তর্বর্তীকালীন জামিনে মুক্তি পান। ২০১৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে দুর্নীতির এই মামলায় বদির বিচার শুরু করেন আদালত। দুদকের পক্ষে মোট ১৩ জন আদালতে সাক্ষ্য দেন।
চলতি বছর ১৯ অক্টোবর যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে বিচারক রায় ঘোষণার জন্য ২ নভেম্বর (বুধবার) তারিখ ঠিক করে দেন। এদিন ঘোষিত রায়ে বদিকে তিন বছর কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
বদি শুধু দুর্নীতি নয়, নানা কারণেই আলোচিত-সমালোচিত। ইয়াবা পাচারের হোতা হিসেবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকাতেও তার নাম আসে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে শিক্ষক, ব্যাংক কর্মকর্তা, মুক্তিযোদ্ধা, আইনজীবী ও সরকারের নির্বাহী প্রকৌশলীকে পিটিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি।