অনলাইন ডেস্ক : পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা পুরোপুরি কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। চারদিক থেকে বিভিন্ন জায়গা শত্রুমুক্ত হওয়ার খবর আসছে। বীর মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে আসছে তাদের মূল লক্ষ্য রাজধানী ঢাকার দিকে। সারা দেশের বেশির ভাগ জায়গায় উড়ছে স্বাধীন মাতৃভূমির লাল-সবুজের প্রিয় পতাকা।
মুক্তিযোদ্ধারা যখন প্রিয় দেশকে শত্রুমুক্ত করে বিজয়ের একদম দ্বারপ্রান্তে; ঠিক তখনই পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দালালরা বেপরোয়া হত্যাযজ্ঞ শুরু করে, যা ১৬ ডিসেম্বরের চূড়ান্ত বিজয়ের আগে পর্যন্ত অব্যাহত রাখে। বিশেষ করে ১৪ ডিসেম্বর ঘাতকরা বেছে দেশের বুদ্ধিজীবীদের নৃশংসভাবে হত্যা করে। বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে হতভম্ব হয়ে যায় মুক্তিপাগল বীর বাঙালি।
আজ ১৫ ডিসেম্বর। একাত্তরের এই দিনে তখন অবরুদ্ধ ঢাকা। থমথমে শহর। ঢাকার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কামানোর গোলার শব্দ ক্রমেই বাড়তে থাকে। পাকিস্তান বাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে আকাশ থেকে লিফলেট ছড়ায় ভারতীয় বিমান। বহিঃপ্রতিরক্ষাবৃত্তে জোরালো আক্রমণ চালায় বাঙালি গেরিলারা। তীব্র হয়ে ওঠে ঢাকা ও এর আশপাশে ভারতের বিমান আক্রমণ। বহুসংখ্যক বেসামরিক কর্মকর্তা চাকরি ছেড়ে বিভিন্ন হোটেলে আশ্রয় নেন। চট্টগ্রাম বন্দরের ছয় কিলোমিটারের মধ্যে ভারতীয় নৌবাহিনী। বন্দরে আগুন জ্বলছে। আত্মসমর্পণ, নাকি চূড়ান্ত যুদ্ধ, সে ভাবনায় অধীর সবাই।
৭১-এর এই দিনে পাকিস্তানি বাহিনী চট্টগ্রামে তাদের ঘাটি ছেড়ে রাউজান হয়ে শহরের দিকে পালিয়ে যায়। এর ফলে শত্রুমুক্ত হয় রাঙ্গুনিয়া। এই দিনে আরো শত্রুমুক্ত হয় পার্বতীপুর, নীলফামারী ও গোয়ালন্দ। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা সন্ধ্যার দিকে চট্টগ্রামের ভাটিয়ারীতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। সারারাত ধরে চলতে থাকে যুদ্ধ। অন্যদিকে বগুড়া জেলা ও পার্বত্য জেলার খাগড়াছড়ি শত্রুমুক্ত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। এই বীরশ্রেষ্ঠ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে যোগ দেন মুক্তিবাহিনীর ৭নং সেক্টরে। তার গুণাবলির কারণে খুব অল্প সময়ে তিনি সবার শ্রদ্ধাভাজন হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর দিনের বেলায় অপারেশনের পরিকল্পনা করতেন আর রাতের বেলায় গেরিলাদের সঙ্গে অপারেশনে বের হতেন। রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ ঘাঁটি হানাদার মুক্ত করার যুদ্ধে তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
অন্যদিকে, লোকচক্ষুর অন্তরালে তখন ঘটে যাচ্ছে অনেক ঘটনা। রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের লাশ। সাধারণ মানুষ জানে না এসবের হদিস; জানে না সেনা সদরে চলছে কোন খেলা। পুরোপুরি কোণঠাসা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা। চারদিক থেকে বিভিন্ন জায়গা শত্রুমুক্ত হওয়ার খবর আসছে। সন্ধ্যয় দক্ষিণ, পূর্ব, পূর্ব উত্তর ও উত্তর দিক থেকে ঢাকা নগরীর উপকণ্ঠে উপস্থিত হয় বাংলাদেশ এবং ভারতের মিলিত বাহিনী। দেশের বেশির ভাগ জায়গায় উড়তে থাকে লাল-সবুজের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের পতাকা।
পাকিস্তান বাহিনী চট্টগ্রামে তাদের ঘাঁটি ছেড়ে রাউজান হয়ে শহরের দিকে পালিয়ে যায়। শত্রুমুক্ত হয় রাঙ্গুনিয়া। মুক্ত হয় পার্বতীপুর, নীলফামারী, গোয়ালন্দ, বগুড়া ও পার্বত্য জেলার খাগড়াছড়ি। সন্ধ্যার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা চট্টগ্রামের ভাটিয়ারীতে হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। সারারাত ধরে চলে যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর।
ঢাকা থেকে পিন্ডিতে পাকিস্তান বাহিনীর বার্তা পাঠানোর সংখ্যা বেড়ে যায়। তাতে ফুটে ওঠে চরম হতাশার সুর। সকাল ১০টায় পাঠানো এক বার্তায় বলা হয়, ‘আমরা আশ্বাসের ওপর বেঁচে আছি। কিছু ঘটবে কি না অনুগ্রহ করে জানান, যা ঘটার সেটা অতি দ্রুত হতে হবে।’
আরেক বার্তায় বলা হয়, ‘আমাদের কোনো মিসাইল নেই, আমরা কীভাবে গোলা নিক্ষেপ করব? কোনো বিমানবাহিনী নেই। বিমান হামলা হয়ে উঠেছে দুশ্চিন্তার কারণ।’
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা ছিল, ‘আমরা সভা করতে যাচ্ছি গভর্নর হাউসে।’ সে খবর পেয়ে ভারতীয় যুদ্ধবিমান সরাসরি গোলা নিক্ষেপ করে গভর্নর হাউসের দরবার হল লক্ষ্য করে। সভা পণ্ড হয়ে যায়। ভয়ে কম্পমান এ এম মালিকের প্রাদেশিক সরকার সদলে পদত্যাগ করে আশ্রয় নেয় ‘নিরাপদ এলাকা’ হিসেবে ঘোষিত হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে।
কিন্তু সেদিন কী ঘটছিল পর্দার অন্তরালে, তার বর্ণনা দেন ঢাকাস্থ জাতিসংঘ উদ্বাস্তুবিষয়ক কর্মকর্তা জন কেলি। তার বর্ণনা মতে, গভর্নর এ এম মালিক তখন যুদ্ধ বন্ধ করতে চান, কিন্তু যোগাযোগ করতে পারছিলেন না নিয়াজীর সঙ্গে। সাহায্য চাইলেন জন কেলির। জন কেলির সেনাবাহিনীর লিয়াজোঁ অফিসার কর্নেল গফুর হোটেলে এসে মালিকের সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে দেন নিয়াজীর। সেই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধবিরতির একটি প্রস্তাব তৈরি হয় বটে, কিন্তু জেনারেল নিয়াজী চাইছিলেন রাওয়ালপিন্ডি থেকে সুস্পষ্ট নির্দেশ আসুক আত্মসমর্পণের জন্য।
একাত্তরের এদিন বিকেল সাড়ে ৩টায় ইয়াহিয়া খানের টেলিগ্রাম আসে। তিনি বলেন, যেহেতু আর প্রতিরোধ সম্ভব নয় এবং চেষ্টা করেও কোনো লাভ নেই, তাই যুদ্ধ বন্ধ করে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করো।’ সে টেলিগ্রামকেই আত্মসমর্পণের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সম্মতি বিবেচনা করে একাত্তরের এ দিনে দখলদার বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী ভারতীয় সেনাপ্রধানের কাছে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাঠান। জেনারেল মানেক শ নির্দেশ পাঠালেন ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টার মধ্যে সদলবলে তাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে।