দেশীয় পুরোনো কাপড়ের কদর

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : রাজধানীতে বেড়েছে দেশীয় পুরোনো কাপড়ের কদর। আর এই পুরোনো কাপড়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিশাল বাজার। দিনে দিনে বাড়ছে এর পরিধি। সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের মানুষের ব্যবহৃত কোন কাপড়ই ফেলনা যায় না। যেগুলোর অবস্থা একটু ভালো সেগুলোর ভালো বাজার আছে। দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষ এর ক্রেতা। একেবারে পুরপুরে ও ছেড়াফাড়া কাপড়েরও বেশ চাহিদা আছে। ছেড়াফাড়া কাপড় ব্যবহৃত হয় ছাপাখানা, যন্ত্র মেরামত কারখানা ও অটোমোবাইল কারখানায়।ব্যবসায়ীরা জানান, দেশী পুরোনো কাপড়ের কারবারে সরাসরি সম্পৃক্ত আছেন  বিপুল সংখ্যক লোক।  প্রতিবছরই এতে যুক্ত হচ্ছে মানুষ, বাড়ছে বিনিয়োগ। স্বল্প পুঁজিতে লাভ বেশি ও ভালো আয় করা যায় বলে রাজধানীতে অনেক লোক এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। অনেকে খণ্ডকালীন ব্যবসা হিসেবে এই কাপড় সংগ্রহ করেন এবং বিক্রি করেন।রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে সদরঘাট, গুলিস্তান, নিউমার্কেট, মোহাম্মদপুর, ফার্মগেট, মহাখালি, আজমপুর, গাবতলী, মিরপুর-১ এবং যাত্রাবাড়ী এলাকায় দেশী পুরোনো কাপড় খুচরা বিক্রি হয়। এসব এলাকায় কোথাও কোথাও পাইকারি বিক্রির ব্যবস্থাও আছে। এর সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার পুরোন ঢাকার বেগমগঞ্জে বেচারাম দেউরিতে। এখানে ছোটবড় মিলিয়ে শতাধিক পাইকারি দোকান রয়েছে। পাজামা, পাঞ্জাবী, লুঙ্গি, টুপি, মোজা, ‍রুমাল, বোরকা, সালোয়ার-কামিজ, ওড়না, ফ্রক, সোয়েটার, জ্যাকেট, বোরকা, বালিশের কভার, বিছানার চাদর, সোফার কভার, দড়জা জানালার পর্দা, সবকিছুই কেনাবেচা হয়।দেশীয় পুরোনো কাপড়ের কারবার হয় তিনটি ধাপে। সংগ্রহ, বাছাই ও বিক্রি। শহরে পাড়া মাহল্লা ও মফঃস্বলে বাড়ি বাড়ি ঘুরে পুরোনো কাপড় সংগ্রহ করেন একদল মানুষ। তারা মুলত ফেরিওয়ালা। সিলভারের নতুন হাঁড়ি-পাতিল, পেঁয়াজ এবং নগদ টাকার বিনিময়ে তারা কাপড় সংগ্রহ করেন। অনেক ফেরিওয়ালা আছেন যারা সরাসরি পাইকারি দোকানে কাপড় দেন। এছাড়া রাজধানীর বেচারাম দেউড়িতে প্রতিদিন ভোরে পুরোনো কাপড়ের হাট বসে। ফেরিওয়ালারা কাপড় এই হাটে আনেন বিক্রির জন্য আর তাদের কাছ থেকে কিনে রাখেন পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা।রাজধানীর মোহাম্মদপুরে জেনেভা ক্যাম্পের কোনায় সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে ভ্যানে করে দেশী পুরোনো কাপড় বিক্রি করেন সেলিম মোহম্মদ। তিনি প্রায় ১২ বছর ধরে এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তিনি জানান, পুরোনো কাপড় সংগ্রহ করার পর তিন ভাগে বাছাই করা হয়। ছেড়া বা ফাটা নয় অর্থাৎ মানের দিক থেকে ভালো কাপড় একদিকে রাখা হয়। ব্যবহার উপযোগী মধ্যম মানের কাপড় আরেকদিকে রাখা হয়। আর ছেড়াফাড়া, পুরপুরে অর্থাৎ ব্যবহার অনুপোযোগী কাপড় রাখা হয় একদিকে। ভালো মানের কাপড় চলে যায় মূল বাজারে। মধ্যম মানের কাপড় চলে যায় দরিদ্র এলাকায়। আর ছেড়াফাড়া কাপড় চলে যায় ওয়ার্কশপে বিক্রির জন্য। সেলিম মোহম্মদ জানান, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তিনি  মহল্লায় ঘুরে ঘুরে পুরোনো কাপড় নগদ টাকায় কেনেন। এছাড়া ফেরিওয়ালার কাছ থেকেও কিনে রাখেন। দোকানে সেগুলো মান অনুয়ায়ী বাছাই করেন। বিকেলে খুচরা বিক্রেতারা এসে পাইকারি দামে কিনে নিয়ে যান। সেলিম মোহম্মদ সপ্তাহে তিনদিন সন্ধ্যার পর ভ্যানে কাপড় নিয়ে বের হন এবং খুচরা বিক্রি করেন।রাজধানীর মোহম্মদপুরের কাটাসুরে পুরোনো কাপড়ের পাইকারি ব্যবসায়ী কুদ্দস মণ্ডল জানান, তিনি প্রথম জীবনে বিদেশে থেকে আসা গাটের পুরোনো কাপড় বিক্রি করতেন। অল্প পুঁজিতে ব্যবসা করা যায় বিধায় তিনি এই লাইনে এসেছেন। স্বাধীনতার পর বিদেশি পুরোনো কাপড়ের ব্যাপক চাহিদা ছিলো। ১৯৮০ এর দশক পর্যন্ত ঢাকার বাজারে এমনকি সারা দেশেই বিদেশি পুরোনো কাপড় প্রচুর বিক্রি হতো। কিন্তু ১৯৯০ এর দশকের শুরুর দিকে গার্মেন্টসের নতুন কাপড়ে বাজার ছেয়ে যায়। এতে নিলামের কাপড়ের (বিদেশি পুরোনো কাপড়) চাহিদা কমে যায়। নিলামের কাপড় এখনও আছে তবে গার্মেন্টসের নতুন কাপড়ের চেয়ে দাম মোটেও কম নয়। একারণে বিক্রি একেবারেই কমে গেছে। দেশি পুরোনো কাপড়ের চাহিদা আগেও ছিলো কিন্তু অত বেশি পাওয়া যেতো না। এখন বেশ পাওয়া যায় এবং তুলনামুলক অনেক কম দামে বিক্রি হয়। দরিদ্র ও শ্রমিক শ্রেণির মানুষ মুলত এই কাপড়ের ক্রেতা।মোহাম্মদপুর সরকারি স্কুলের সামনে সেলিম মোহম্মদের ভ্যানে শার্ট দেখছিলেন যুবক দেলু হোসেন। তিনি রাজমিস্ত্রীর যোগালি হিসেবে কাজ করেন মোহম্মদপুর এলাকায়। বাড়ি রংপুরের পীরগাছায়। দেলু জানান, কম পয়সায় এই কাপড় পাওয়া যায় বলে তিনি এগুলোই কেনেন। দেখে কিনতে পারলে নতুনের চেয়ে কম না। ৫০ টাকার মধ্যেই ভালো শার্ট পাওয়া যায়।বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের গেটে এবং কাকরাইল মসজিদের পাশে অস্থায়ী দোকানে বিক্রি হয় দেশীয় পুরোনো কাপড়। বায়তুল মোকাররমের সামনে একজন বিক্রেতা আশরাফ আলী জানান, বিদেশী পুরোনো কাপড় ধীরে ধীরে বাজার হারাচ্ছে। কারণ, বিদেশী কাপড় যত নিম্ন মানেরই হোক খুচরা প্রতিটি দু’শ টাকার কম বিক্রি করলে পোষানো যায় না। ক্রেতারা প্রায় এই টাকায় গার্মেন্টসের নুতন কাপড়ই পান। সেজন্যই বিদেশী পুরোনো কাপড়ের জায়গায় বাজার পাচ্ছে দেশীয় পুরোনো কাপড়।