একাত্তরলাইভডেস্ক: থাইল্যান্ডে রাজা ভুমিবল আদুলাদেজের মৃত্যুর পর তার ছেলে যুবরাজ মাহা ভজিরালংকর্নের সিংহাসনে আরোহণ করার কথা। তিনিই থাই সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। রাজার মৃত্যুর পর যুবরাজকে উত্তরাধিকারসূত্রে পরবর্তী রাজা হিসেবে ঘোষণা করা হবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা হয়নি। গত ১৩ অক্টোবর রাজা ভুমিবলের মৃত্যুর খবর ঘোষণা করার দুই ঘণ্টা পর স্থানীয় সময় রাতেই জাতীয় আইনসভার বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়। এই অধিবেশনের উদ্দেশ্য ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে যুবরাজকে নতুন রাজা হিসেবে ঘোষণা করা। আইনসভার সদস্যরা ভেবেছিলেন তারা যুবরাজকে সিংহাসনে বসার জন্য আমন্ত্রণ জানাবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। আইনসভার অধিবেশনের আগে প্রধানমন্ত্রী প্রায়ুথ চান-ওচা বৈঠকে বসেন যুবরাজের সঙ্গে। এরপর আইনসভাকে জানানো হয় যে, নতুন রাজার নাম এখনই ঘোষণা করা হবে না। আইনসভার সদস্যরা বিশেষ অধিবেশনে যোগ দিয়ে প্রয়াত রাজার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে নয় মিনিট নীরবতা পালন করেন এবং পরে বাড়ি চলে যান। সাংবিধানিক ও স্বাভাবিক নিয়মে রাজার মৃত্যুর পর দ্রুততম সময়ে নতুন রাজার শপথ নেওয়ার কথা এবং সিংহাসনে বসার কথা। কিন্তু রাজা ভুমিবলের মৃত্যুর পর এক সপ্তাহেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। অথচ সবকিছু ঠিকঠাক থাকা সত্ত্বেও নতুন রাজা হিসেবে যুবরাজের নাম ঘোষণা হয়নি। এদিকে সাংবিধানিক উত্তরাধিকারী থাকা সত্ত্বেও রাজার মৃত্যুর পর সিংহাসন শূন্য পড়ে থাকায় দেশে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। নতুন করে তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক সংকট।থাইল্যান্ডের রাজা মূলত সাংবিধানিক রাজা। ভুমিবল আদুলাদেজ টানা ৭০ বছর সিংহাসনে আসীন ছিলেন। সাংবিধানিক রাজা হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও রাষ্ট্রের অভিভাবক। গরিব নাগরিকদের প্রতি দরদি হিসেবে তার খ্যাতি ছিল। তার অধীনেই থাইল্যান্ড একটি দরিদ্র দেশ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটেছে। দেশের মানুষ রাজা বলতে ভুমিবলকেই জানেন। কারণ, তিনি টানা ৭০ বছর সিংহাসনে থাকায় বেশির ভাগ মানুষ রাজা হিসেবে কেবল তাকেই দেখেছেন। তিনি দেশের মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন। তার মৃত্যুর খবর শুনে মানুষ ঘর ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসে চোখের পানি ফেলেছে, তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে। রাজার ছেলে পরবর্তী রাজা হবেন- এই মানসিক প্রস্তুতি তাদের ছিল এবং আছে। সাধারণ নাগরিকরা রাজাকে তাদের সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবেই দেখেন। এটা তাদের আবেগের বিষয়। সে ক্ষেত্রে নতুন রাজা হিসেবে প্রয়াত রাজার ছেলের নাম এখনো ঘোষণা না হওয়ায় একটা সামাজিক উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। তাহলে দেশের নতুন রাজা কবে নাগাদ সিংহাসনে বসবেন? যুবরাজ শেষ পর্যন্ত সিংহাসনে বসতে পারবেন তো- এসব প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের সমাজ ও রাজনীতির ময়দানে, এমনকি দেশের বাইরের অঙ্গনে। থাইল্যান্ডে বর্তমান সরকার ও আইনসভা সামরিক বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট। ইতিমধ্যেই যুবরাজ ঘোষণা দিয়েছেন যে, পিতার মৃত্যুতে তিনি শোকগ্রস্ত এবং আপাতত সিংহাসনে বসার মতো মানসিক অবস্থা তার নেই। তিনি রাজা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তুতির জন্য এক বছর সময় চেয়েছেন। দেশবাসীর কাছে যুবরাজ ভজিরালংকর্নের কোনো পরিচ্ছন্ন ইমেজ নেই। তিনি একজন ফাটকা ব্যক্তি ও প্লেবয় হিসেবে পরিচিত। উচ্ছৃঙ্খল জীবন এবং উড়নচণ্ডী স্বভাবের জন্য তিনি সমালোচিতও। তারপরও যুবরাজ বলে কথা, আর তিনিই দেশের পরবর্তী রাজা- এটা থাইবাসী মেনে নিয়েছেন। কেননা, এটা তাদের সামাজিক আবেগের বিষয়। কিন্তু পরিস্থিতি বলছে অন্য কথা। সামরিক সমর্থনপুষ্ট সরকার বলছে, যুবরাজ ভাজিরালংকর্ন এখনই সিংহাসনে বসবেন না। তিনি তার অভিষেকের জন্য অন্তত এক বছর অপেক্ষা করতে চান। আর এই সময়ের মধ্যে রাজকার্য চালাবেন একজন রাজপ্রতিনিধি। তিনি হচ্ছেন থাইল্যান্ডের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রেম তিনসুলানন্দা। রাজা ভুমিবলের সঙ্গে প্রেম তিনসুলানন্দার ঘনিষ্ঠতা সর্বজনবিদিত। তিনি রাজা ভুমিবলের বন্ধু ও তাদের সখ্য দীর্ঘদিনের। তিনসুলানন্দার বয়স ৯৬। একজন সুশাসক ও শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবে তার সুনাম রয়েছে। সংঘাত এড়িয়ে সমঝোতার পথ অনুসরণের কারণে তার জনপ্রিয়তাও রয়েছে। তিনি রাজ উপদেষ্টা পরিষদ প্রিভি কাউন্সিলের প্রধান এবং ১৯৯৮ সাল থেকে এই দায়িত্ব পালন করছেন। প্রয়াত রাজার মেয়ে প্রিন্সেস মাহা চাকরি সিরিনধর্ন- এর সাথে তার সম্পর্ক ভালো। প্রিন্সেস সিরিনধর্নও থাইবাসীর কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়। বাবার বন্ধু ও সহচর হিসেবে প্রিন্সেস সিরিনধর্ন তাকে পিতৃতুল্য মনে করেন,অভিভাবক হিসেবে গণ্য করেন। সর্বোপরি রাজপরিবারে তার একটা উচ্চ আসন রয়েছে। প্রেম তিনসুলানন্দা ১৯৮০ সালে থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন এবং আট বছর এই পদে ছিলেন। এই সময়ে দুটি সামরিক অভ্যুত্থান চেষ্টা ও সামরিক বাহিনীর কিছু সংকট সামাল দিতে সক্ষম হন। সামরিক বাহিনীর অশুভ তৎপরতার কারণে দেশে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হলে তিনি দক্ষতার সঙ্গে তা মোকাবিলা করে দৃঢ়তার সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন।প্রেম তিনসুলানন্দার জন্ম ১৯২০ সালে থাইল্যান্ডের সঙ্খলা প্রদেশে। ১৯৪১ সালে তিনি থাই রাজকীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। একজন নবীন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে তিনি ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রে সামরিক প্রশিক্ষণ লাভ করেন। সেনাবাহিনীতে তার দ্রুত পদোন্নতি ঘটে এবং জেনারেল পদমর্যাদায় উন্নীত হন। তিনি জীবনের শুরু থেকেই ছিলেন রাজপরিবারের অনুগত এবং রাজার অত্যন্ত বিশ্বস্ত জন। তার জোরালো সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতার কারণেই থাইল্যান্ডে রাজসিংহাসন সাংবিধানিক বৈধতা পায় এবং তিনি রাজপরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে আবির্ভূত হন। একজন প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে সেনাবাহিনীতে তার প্রভাব এখনো বিদ্যমান। যত দিন নতুন রাজার নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা না হয় তত দিন প্রিভি কাউন্সিলের প্রধান হিসেবে সাংবিধানিকভাবেই পদাধিকারবলে রাজার প্রতিনিধিত্ব করবেন প্রেম তিনসুলানন্দা। তিনিই এখন থাইল্যান্ডের অভিভাবক, রাজপ্রতিভূ।
থাইল্যান্ডে রাজপ্রতিভূ

October 22, 2016