মাহাবুবুর রহমান, প্রতিনিধি কক্সবাজার
কক্সবাজারে রাখাইন সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী জলকেলি উৎসব শুরু হয়েছে। রাখাইন সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুনী থেকে শুরু করে নানা বয়সী মানুষ একে অপরের গায়ে ‘পবিত্রতার প্রতীক’ পানি ছিটিয়ে, নিজেদের শুদ্ধ করে নেওয়ার প্রত্যাশায় এই উৎসবে শামিল হয়েছেন। পুরোনো দিনের সকল গ্লানি ও সকল জরা-জীর্ণতাকে ধুয়ে-মুছে তারা পবিত্রভাবে বরণ করে নিতে চান নতুন বছরকে।
জলকেলি উৎসব ঘিরে কক্সবাজার শহরের সর্বত্র বিরাজ করছে আনন্দমুখর পরিবেশ। গতকাল সোমবার থেকে শুরু হওয়া এ উৎসব চলবে বুধবার পর্যন্ত। রাখাইন সম্প্রদায়ের বর্ষ পঞ্জিকা অনুসারে গত রোববার শেষ হয়েছে ১৩৭৮ মগীসন। গতকাল সোমবার থেকে শুরু হয় রাখাইনদের নববর্ষ ১৩৭৯ সন। প্রতিবছর এই নববর্ষ উপলক্ষ্যে রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজন তাদের সামাজিক নিয়ম মতে আয়োজন করে পুরনো বছরের বিদায় ও নতুন বছর বরণ অনুষ্ঠান। রাখাইনদের ভাষায় এই আনন্দ আয়োজনকে বলা হয় ‘সাংগ্রেং পোওয়ে’ বা বর্ষবরণ উৎসব। যা মূলত শুরু হয়েছে ১৩ এপ্রিল থেকে।
রাখাইন সম্প্রদায়ের নেতা, কক্সবাজার সিটি কলেজের অধ্যক্ষ ক্য থিং অং বলেন, ‘চৈত্র সংক্রান্তি থেকে রাখাইনদের বর্ষবরণ উৎসব শুরু হয়ে চলে প্রায় সপ্তাহজুড়ে। উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্ব ‘পানি খেলা’ বা ‘জলকেলি’ বৈশাখের চতুর্থ দিন থেকে শুরু হয়। চলে ষষ্ঠ দিন পর্যন্ত। সেই হিসেবে জলকেলি উৎসব চলবে ৬ বৈশাখ পর্যন্ত (১৭ এপ্রিল থেকে ১৯ এপ্রিল)।’
খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, রাখাইনদের এ উৎসবের মূল লক্ষ্য অতীতের সকল ব্যাথা-বেদনা, গ্লানি ভুলে গিয়ে ভ্রাতৃত্ববোধের মাধ্যমে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়া। রাখাইন তরুন-তরুনীরা নতুন ও আকর্ষণীয় পোষাক পরে সেজেগুজে রাস্তার মোড়ে এবং রাখাইন পপ্লীতে তৈরি করা জলকেলি উৎসবের প্যান্ডেলে গিয়ে একে অপরকে পানি নিক্ষেপ করে আনন্দ প্রকাশ করে। এসময় নাচ-গানসহ চলে আনন্দঘন অনুষ্ঠান। সাথে ঢাক-ঢোল আর কাঁসার তালে-তালে নেচে উঠে রাখাইন আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার প্রাণ। কক্সবাজার শহরে রাখাইন সম্প্রদায়ের ‘সাংগ্রেং পোওয়ে’ উৎসবের প্রধান স্থান হলো অ¹মেধা ক্যাং এলাকা। সেখানে ‘জলখেলির’ জন্য বড়ো প্যান্ডেল তৈরীর পাশাপাশি বর্ণাঢ্য পরিসরে নৃত্য-গাণসহ নানা আকর্ষনীয় অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে। তাই ‘জলকেলি’ উৎসবের মধ্যমণি হয়ে ছিলো এলাকাটি। এছাড়া শহরের টেকপাড়াসহ বিভিন্ন স্থানে রাখাইনদের বাড়ির উঠোনে-উঠোনে প্যান্ডেল তৈরী করে চলে জলকেলির আয়োজন। ওখানে রাখাইন সম্প্রদায়ের নানা বয়সের নারী-পুুরষের সম্মিলিত নাচ-গান চলে। রাখাইন যুবকরা গান ও বাদ্যের তালে-তালে গিয়ে হাজির হন প্যান্ডেলগুলোতে। প্যান্ডেলের ভেতরে পানি নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন রাখাইন তরুণীরা। শুরু হয় একে অপরের গায়ে পানি ছিটানোর পালা। এই উৎসবকে ঘিরে কক্সবাজার শহরের টেকপাড়া, বৌদ্ধমন্দির সড়ক, মাছবাজার এলাকা, কক্সবাজার সদর উপজেলার চৌফলদন্ডী এলাকা ছাড়াও মহেশখালীর গোরকঘাটা রাখাইনপাড়াসহ টেকনাফ, রামু ও চকরিয়া উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বসবাসরত রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজন নানা আনন্দ আয়োজন করেছে।
কক্সবাজার সরকারি কলেজে অধ্যয়নরত টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের স্থায়ী বাসিন্দা রাখাইন তরুন জজ ওয়ান বলেন, ‘জলকেলি কোন ধর্মীয় উৎসব নয়। কিন্তু সামাজিক রীতি অনুযায়ী ধুম-ধামের সাথে আনন্দমূখর পরিবেশে রাখাইন নববর্ষ উদযাপন করা হয়। রাখাইন নববর্ষ বরণের অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবেই কক্সবাজারের রাখাইনরা একে-অপরকে পানি নিক্ষেপ করার খেলায় মেতে উঠেছে। তারপরও নতুন বছর যেন ভালো কাটে এই কামনায় আয়োজন করা হয় নানা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের।’