গুড বুকে সৈয়দ আশরাফ

একাত্তলাইভ ডেস্ক: গতানুগতিক ধাঁচে নয়, বরং অন্য ধাঁচে রাজনীতিতে আস্থা ও বিশ্বাসে নিজস্ব একটি গ্রহণযোগ্য ভূমিকা অর্জন করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। সাংগঠনিক পদমর্যাদায় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরেই প্রভাবশালী নেতা হয়েও তিনি অনেকটা নিভৃতচারী থেকেও দলীয় ভূমিকা পালনে সব সময় সচেষ্ট রয়েছেন।দলীয় প্রয়োজন বা সংকটকালে তাকে অনেকবারই ইস্পাত কঠিন দৃঢ় মনোভাবে সামনের সারিতে দেখা গেছে। স্বল্পভাষী অথচ প্রয়োজনে স্পষ্টবাদী, সে তুলনায় একেবারেই প্রচারবিমুখ এই নেতার বক্তব্যে দলীয় নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষও খুঁজে পান সংকট উত্তরণের দিশা। এমনটাই মনে করছেন দলের অন্যান্যরা।এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘সৈয়দ আশরাফ নেত্রীর প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বাস দিয়েই আজকের অবস্থানে এসেছেন। তিনি কখনো রাজনীতিতে নিজের বিষয়টিকে তুলে আনতে চান না। তিনি সব সময় চেয়েছেন নেত্রীর বিষয়টি তুলে আনতে।’সৈয়দ আশরাফের জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯৫২ সালে। পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম। জাতীয় চার নেতার অন্যতম নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৭৫ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঘাতকের বুলেটে মৃত্যুবরণ করেন। পিতার মৃত্যুর পর সৈয়দ আশরাফ পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যে। বসবাস শুরু করেন লন্ডনের হ্যামলেট টাওয়ারে। ধীরে ধীরে সক্রিয় হয়ে ওঠেন লন্ডনে বাংলা কমিউনিটির বিভিন্ন কার্যক্রমে। দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় দেশে ফেরেন ১৯৯৬ সালে। কিশোরগঞ্জ-১ আসন থেকে অংশ নেন ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে। প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হন সংসদ সদস্য। এরপর ২০০১ সালে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও বিএনপি-জামায়াত চার দলীয় জোট সরকার গঠন করে। এ সময় বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য হিসেবে পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গন সরগরম হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৮ সালে সাধারণ নির্বাচন দেয়। এরপর আশরাফ তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দায়িত্ব পান স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের। পরবর্তী নির্বাচনেও একই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পুনরায় দায়িত্ব পান স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। পরবর্তী সময়ে সেখান থেকে সরিয়ে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের। পাশাপাশি তিনি টানা মেয়াদে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। ২২ ও ২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনে পুনরায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলে তৃতীয় বারের মতো দায়িত্ব পালন করবেন তিনি।জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলামের সন্তান হিসেবে সৈয়দ আশরাফের রাজনীতিতে আসা কোনো অমূলক ঘটনা ছিল না। খুব ছোটবেলা থেকেই রাজনীতিক পিতাকে দেখে বড় হয়েছেন। তার পিতা তখন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পুরোদমে সক্রিয়। এক পর্যায়ে তিনি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব পালন করেন ভারপ্রাপ্ত সভাপতির। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই রাজনীতিতে আসেন সৈয়দ আশরাফ। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের মাধ্যমে রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়। স্বাধীনতার পর তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর নির্বাচিত হন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক।সৈয়দ আশরাফ রাজনৈতিক জীবনে দলের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য মাইনাস-টু ফমুর্লা কার্যকর করতে পর্দার অন্তরালে কুশীলবরা তখন সক্রিয়। এমন বৈরী পরিবেশে জিল্লুর রহমানের সঙ্গে মিলে দলীয় সভানেত্রীর পক্ষে শক্ত অবস্থান নেন আশরাফ। তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল গ্রেফতার হলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশেও সক্রিয় থেকে দলীয় সভানেত্রীর পক্ষে দৃঢ়চেতা অবস্থান নেন। এতে পিছু হটতে বাধ্য হয় ‘মাইনাস-টু’কুশীলবরা। এই অনবদ্য ও সাহসী ভূমিকায় পরবর্তীতে ২০০৯ সালে কাউন্সিলে তিনি প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পরও সংকটের মুহূর্তে তিনি রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তার প্রমাণ মেলে ৫মে হেফাজতের ঢাকা অবস্থানকে কেন্দ্র করে। সারাদিন শেষে যখন চারদিকে চরম আতঙ্ক ও অস্থিরতা তখন সৈয়দ আশরাফ উচ্চারণ করেন কঠোর হুঁশিয়ারি। পরিস্থিতি মোকাবেলায় রাখেন কঠোর ভূমিকা। এমনকি বিএনপি-জামায়াত জোটকে বাইরে রেখে একতরফা নির্বাচন প্রশ্নে বিদেশিদের চাপ মোকাবিলায়ও তিনি ছিলেন সক্রিয়। তিনি স্পষ্টভাষী, মৃদুভাষী ও মিডিয়াবিমুখ। অকারণ বা অপ্রয়োজনে কথা বলেন না গণমাধ্যমের সামনে। কিন্তু প্রয়োজনে যখন যা বলেন তা গুরুত্ব ও সর্বজনগ্রাহী হয়। তিনি নিজ দলের লোকদেরও কঠোর হুঁশিয়ারি বার্তা দিতে পিছপা হন না। যে কারণে তার মুখে উচ্চারিত হয় অনেক কঠিন সত্য।তিনি অকপটে নিজ দলের লোকদের ‘খাই খাই স্বভাব থেকে বিরত থাকার’ পরামর্শ দেন। জাতির জীবনে আরেকটি ১৫ আগস্টের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে সেজন্যও নেতাকর্মীদের সজাগ ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানান।২০১৫ সালের জুলাইয়ে সৈয়দ আশরাফকে নিয়ে দলে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়। দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ তিনি হারাবেন কিনা- এ নিয়ে গুঞ্জন ওঠে। সেগুলো মিথ্যা প্রমাণিত হতে বেশি সময় লাগেনি। এ সময় সৈয়দ আশরাফ বলেন, ‘আমি লাভের জন্য রাজনীতি করি না। আমার পিতা সততার সঙ্গে রাজনীতি করেছেন, দলের নেতার জন্য মৃত্যুবরণ করেছেন। এটাই আমার রক্ত।`এরপরও কিছু কারণে তার বিরুদ্ধে সমালোচনা শোনা যায়। সমালোচকদের মতে, সৈয়দ আশরাফ মন্ত্রণালয়ে বরাবরই গরহাজির থাকেন। রাতে আড্ডাবাজিতে ব্যস্ত থাকেন। আর দিনে ঘুমিয়ে সময় পার করেন। তিনি দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন না। নির্দিষ্ট বলয়ের বাইরে অন্য কোনো নেতাকর্মীর ফোন রিসিভ করেন না। তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠনকে শক্তিশালী করতে তেমন কোন দৃশ্যমান ভূমিকাও রাখেন না।এসব সমালোচনার জবাবে আশরাফ ঘনিষ্ঠরা জানান, তিনি যদি সংগঠন বিমুখ নেতাই হতেন তাহলে দলীয় প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাওয়ার পর ধানমন্ডিতে রাজনৈতিক কার্যালয়ে টানা তিন দিন সকালে নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করতেন না। তিনি প্রয়োজন হলেই সময় দেন। অপ্রয়োজনে সময় ব্যয় করেন না। অপ্রয়োজনীয় কথাও বলেন না। রাজনীতির স্টান্টবাজি তিনি বিশ্বাস করেন না বলেই তিনি ব্যতিক্রমী নেতা। যে কারণে তাকে অনেকে ভুল বোঝে।আশরাফ ঘনিষ্ঠরা আরও জানান, এক-এগারো থেকে পরবর্তী সময়ে দায়িত্ব পালনকালে তিনি আওয়ামী লীগের সকল সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দিয়ে ‘শেখ হাসিনা বলয়’প্রতিষ্ঠিত করেন। যার সুফল আজকের আওয়ামী লীগ পাচ্ছে। তারা আরও জানান, তিনি প্রতিদিনই সকালে ঘুম থেকে ওঠেন। এরপর কম্পিউটারের সামনে বসেন। ইন্টারনেটে দেশী-বিদেশী পত্র-পত্রিকা ঘাটাঘাটি করেন। অবগত হন দেশীয় ও বৈশ্বিক রাজনীতির বিভিন্ন প্রেক্ষাপট। এর প্রতিফলন তিনি দেখান তার বিভিন্ন রাজনৈতিক বক্তৃতায়। এ ছাড়াও দলীয় নেতাকর্মীদের অন্যায় তদবির-আবদার এড়ানোর জন্যও তিনি নিভৃতে থাকেন।প্রসঙ্গত, ঈদুল আজহার পরদিন কানাডায় গ্লোবাল ফান্ড সম্মেলন এবং যুক্তরাষ্ট্রে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে ঢাকা ছাড়েন প্রধানমন্ত্রী। দীর্ঘ সফর শেষে গত ৩০ সেপ্টেম্বর শুক্রবার বিকেলে দেশে ফেরেন তিনি। এ সময় ২০ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টানা দলীয় সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে সম্পাদকমন্ডলীর সভাসহ দুটি যৌথসভায় সভাপতিত্ব করেন । প্রধানমন্ত্রী সফল সফর শেষে দেশে ফিরলে তাকে গণসংবর্ধনা দেয়ার লক্ষ্যে এসব সভা অনুষ্ঠিত হয়।ঠাকুরগাঁও বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রবীর কুমার রায় রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এক-এগারোর সময় যে ভূমিকা রেখেছেন সেই ভূমিকার জন্যই তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি প্রেস বিফ্রিংয়ে এত মেপে মেপে কথা বলেন যা অন্য অনেক নেতাই বলতে পারেন না। ওই অল্প কথার মধ্যেই অনেক কিছু থাকে। যা শুনে আমরা দিক-নির্দেশনা পাই। আর মানুষ হিসেবে তিনি তো অসাধারণ। কেবল তার সাক্ষাত সহজে পাওয়া যায় না- এটাই অনেকে অভিযোগ করেন।’এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতা জানান, সৈয়দ আশরাফ নিজস্ব স্টাইলে রাজনীতি করেন। অতীতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে প্রয়াত জিল্লুর রহমান যে সকল গুণাবলীর কারণে বারবার সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন সেই একই কারণে সৈয়দ আশরাফও এখন নেত্রী ও দলের কাছে সেই আস্থায় পৌঁছে গেছেন। এই কারণেই তিনি এবারের সম্মেলনেও সাধারণ সম্পাদক হিসেবেই ‘ফাস্ট চয়েসের গুডবুকে’ আছেন।