কু সি ক জেগে ঘুমাচ্ছে: নগরীর শতাধিক ভবনে মৃত্যু ঝুঁকিতে হাজার ও মানুষ

এম এস শফি: কুমিল্লা দেশের নবগঠিত সিটি কর্পোরেশনগুলোর অন্যতম। এটি এক সময় দেশের অন্যতম প্রাচীন পৌরসভা ছিল। ১৮৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ছিল এই পৌরসভাটি । শিক্ষা সংস্কৃতির পাদপীঠ কুমিল্লা পৌর এলাকাধীন অংশে বিভিন্ন সময়ে গড়ে উঠে অনেক ভবন। এরমাঝে বেশ কিছু সরকারী ভবনও রয়েছে। এই নগরী পৌরসভা থাকাকালীন বহু ভবন পরিত্যক্ত ঘোষনার পরও সেগুলো ভাঙ্গার কোন উদ্যেগ নিতে পারেনি সংশ্লিস্ট কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে বিগত ২০১১ সালের ১০ জুলাই সিটি কর্পোরেশনে উন্নিত হয় কুমিল্লা পৌরসভা থেকে। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারী হয় সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। এরপরও ৫ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে । নগরীর বিভিন্ন প্রান্তে থাকা একশত দশটি ব্যবহারের অনুপযোগী ভবন ভেঙ্গে ফেলতে কোন উদ্যোগ নেই সিটি কর্পোরেশনের। এক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বশীলদের বক্তব্য আমরা পরিত্যক্ত ভবনগুলোর মালিকপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছি কোন দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায়ভার ভবন মালিকদের নিতে হবে। আর এই কথাতেই যেন তাদের দায়িত্ব শেষ। আর নিরবে পরিত্যাক্ত ভবন মালিকরা ভাড়ায় খাটাচ্ছে তাদের পরিত্যক্ত ভবনগুলো । কেউবা দোকান কেউবা কোন পরিবারকে এসব পরিত্যাক্ত ভবন ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। সচেতন নগরবাসীর প্রশ্ন ? পরিত্যক্ত ভবনগুলো ভাঙ্গার দায়িত্ব কি সিটি কর্পোরেশন না মালিকপক্ষের? দৈবচক্রে যদি পরিত্যক্ত কোন ভবন ধ্বসে হতাহতের ঘটনা ঘটে তবে কে নিবে এর দায়িত্ব? সংশ্লিস্ট কর্তৃপক্ষ কি তখন এর দায়ভার এড়াতে পারবেন।
কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন। ৫৩.৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত সিটি কর্পোরেশন ২৭টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত। সাবেক কুমিল্লা পৌরসভার ১৮টি ওয়ার্ডের সাথে পাশের সদর দক্ষিণ পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ড নিয়ে এটা গঠিত হয়েছে। নগরীর বিভিন্নস্থানে রয়েছে বহু পুরাতন ঘর-বাড়ি। শতাব্দি প্রাচীন এই ভবনগুলোর অনেকটি এরই মাঝে অনুপযোগী হয়ে পড়েছে বসবাসের। তবুও এসকল বাসা-বাড়িতে কেউ বসবাস করছে কেউবা পরিচালনা করছে তাদের ব্যবসা বাণিজ্য। কোন ভবনের মালিক বা সরকার পক্ষ। বিভিন্ন সময়ে সাবেক পৌর বা বর্তমান সিটি কর্পোরেশন এইসকল বসবাসের অনুপযোগী ভবনসমূহ ভাঙ্গার নোটিশ দিলেও কার্যকর হয়নি। সর্বশেষ বিগত ২০১৩ সালের ২৮ এপ্রিল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মনিরুল হক সাক্কু’র নির্দেশে প্রকৌশল শাখা নগরীর ১’শ ১০ ভবন বসবাসের অনুপযোগী চিহ্নিত করে ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দেয়। কিন্তু দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে ৩ বছর। সির্দ্ধান্ত বাস্তবায়নে কেন জানি পিছু হটছে সিটি কর্পোরেশন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক দায়িত্বশীল সুত্র জানায়, নগরীর পরিত্যাক্ত বা ঝুঁকিপূর্ণ বাসা-বাড়ি বা ভবনগুলোর মালিক পক্ষ কোন না কোনভাবে রাজনৈতিক আশির্বাদপুষ্ট। ফলে সির্দ্ধান্ত নিলেও বাস্তবায়নে গড়িমসি করছে সিটিকর্পোরেশন। নগরীর প্রানকেন্দ্র কান্দিরপাড়। এখানে ১৯১৪ সালে নির্মিত হয় পূবালী ব্যাংক ভবন । বর্তমানে এটি পরিত্যাক্ত ঘোষনা করা হয়। একইভাবে শত বর্ষের পুরনো যেমন বহু ভবন পরিত্যক্ত তেমনি বিগত শতকের ৮০/৯০ দশকে এমনকি চলতি শতাব্দির শুরুতে নির্মিত অনেক ভবন ইতিমধ্যে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। নগরীর কেন্দ্রস্থল কান্দিরপাড় এলাকার শত বর্ষের পুরনো পূবালী ব্যাংক ভবনটি ২০১৩ সালের ২৮ এপ্রিল ভেঙ্গে ফেলার নোটিশ দেয় সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু আজও সেটা দাড়িয়ে আছে। ফলে চরম ঝুঁকিতে এর পাশ দিয়ে লোকজন চলাচল করছে প্রতিদিন। আর এরই মাঝে চলতি বছরের ২৫ জুলাই ব্যস্ততম নগরীর প্রানকেন্দ্রের সড়কের পাশে থাকা পূবালী ব্যাংক ভবনের ছাদের কিছু অংশ ভেঙ্গে পড়লে আহত হয় দু’জন লোক। তখন আবারো ভেঙ্গে ফেলার দাবী উঠলেও অন্য একটি গ্রুপ পুরাতন এই ভবনটি সংরক্ষনের দাবী তোলে। ফলে বর্তমানে নিরব সিটিকর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ। প্রতিদিন এই ভবনের পাশ দিয়ে শত শত রিক্সা,অটোরিক্সা,ইজিবাইকসহ অন্যান্য যানবাহনে করে হাজার হাজার মানুষ চলাচল করছে। পাশাপাশি ভবনটির নীচে রয়েছে ১৪ টি দোকান। নগরীর বাদুরতলা এলাকায় রয়েছে চৌধুরী মার্কেট নামের একটি বানিজ্য বিপনী। তিনতলা ভবনের এই প্রতিষ্ঠানটির এক ও দুই তলায় রয়েছে প্রায় অর্ধ্বশতাধিক বিভিন্ন ব্যবসা ও দোকান-পাট । উপর তলায় রয়েছে মসজিদ,এতিম ও হাফেজখানা। এরপাশেই আছে পৌর কর্মকর্তা-কর্মচারী মাকেট। এমনিভাবে ধর্মসাগরপাড় মহিলা কলেজ ভবন,দক্ষিণ চর্থা ছাত্রাবাস,ইশ্বর পাঠশালা স্কুলের প্রবেশ পথের পুরাতন ভবন,রামঘাট এলাকার বিএমএ ভবন,মনোহরপুর কৃষি ব্যাংক ভবন,আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম ভবন,চকবাজারের দুলা মিয়া মার্কেট,রানীর দিঘীর পাড় পুরাতন হোস্টেল,রাজগঞ্জ জাতীয় পার্টি কার্যালয়,শাসনগাছা এলাকায় জাফর খান সড়কের আবুল কালাম আজাদের একতলা ভবন,একই এলাকার মোহাম্মদ বদরুল হুদার বাড়ি,ধর্মসাগর পশ্চিম পাড়ের সাবেক ডিআইজি প্রিজনের বাসভবন,লিবার্টি সিনেমা হল,টমসমব্রীজ এলাকায় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারী কলেজ ছাত্রাবাস,ছোটরা এলাকায় মৃত সামসুল হক চৌধুরীর দ্বিতল ভবন। কুমিল্লা কারাগার সংলগ্ন নতুণ জেলা পরিষদ ভবনে দেখা দিয়েছে ফাঁটল। ২০০৩-০৪ সালে কাজ শুরু হয়ে ২০০৫ সালের জুন মাসে নির্মান কাজ শেষ হয়েছিল ভবনটির। নগরীর সার্কিট হাউজ রোডে টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন অফিসের পুরোটাই ব্যবহারের অনুপযোগী। তবুও চলছে সরকারী কার্যক্রম। এটির নির্মান কাল ছিল ১৯৭৪ ইং। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ’র ৩ তলা দু’টি ছাত্রাবাস ভবনের বিভিন্নস্থানেও ফাটল দেখা দিয়েছে। এদ’ুটি ভবনে মোট কক্ষ রয়েছে ৫৮টি। ২০০৮ সালে এই ভবন দু’টি নির্মিত হয়েছিল। কুমিল্লা মহানগরীর ঝুঁকি বা পরিত্যাক্ত সবগুলো ভবনই এখনো মানুষ বসবাস বা ব্যবসা পরিচালনা করছে। একটি দায়িত্বশীল নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুত্র জানায়,কুমিল্লা মহানগরীর পরিত্যাক্ত ১ শতাধিক ভবনে কমপক্ষে ৫ হাজারেরও বেশী লোকজন বসবাস বা ব্যবসা পরিচালনা করছে। তাছাড়া গুরুত্বপূর্ণ সড়কের পাশে থাকা ভবনগুলোর পাশ দিয়ে প্রতিদিন চলাচল করছে হাজার হাজার মানুষ। যে কোন সময় ভেঙ্গে পড়তে পারে কোন না কোন ভবন। আর এতে হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারে অনেক। সুত্র আরো জানায়,আকস্মিক ভেঙ্গে পড়ার পর প্রশাসনের ব্যস্ততা হয়তো বেড়ে যাবে। একপক্ষ অন্য পক্ষের উপর দোষ চাপানো শুরু করবে। কিন্তু এখনই যদি পরিত্যক্ত ভবনগুলো ভেঙ্গে ফেলে তাহলে হয়তো ভবিষ্যতে বড় ধরনের কোন হতাহতের ঘটনা ঘটবেনা। নোটিশ দিয়ে পরিত্যক্ত ভবনে বসবাসের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি কতটা কার্যকর জানতে চাইলে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ নুরুল্লাহ বলেন,ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোতে বসবাস না করার জন্য লাল কালি দিয়ে লিখে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি দ্রুত ভেঙ্গে ফেলারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন,পরিত্যাক্ত ভবন মালিকদের বলে দেওয়া হয়েছে,কোন দুর্ঘটনার জন্য সিটি কর্পোরেশন দায়ি থাকবে না।