ঐশী থেকে সুমন : মাদকের ভয়াল থাবায় বিপন্ন তরুণ

একাত্তরলাইভডেস্ক: দেশে মাদকাসক্তের হার দ্রুত বেড়ে চলেছে। মাদকাসক্তের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এমনকি মাদকাসক্তের এই ভয়াল থাবা থেকে রেহাই পাচ্ছে না স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থীরাও। মাদক সেবনের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয় ১৫ থেকে ৩০ বছরের বয়সীদের মধ্যে। এর ফলে একদিকে যেমন তাদের উচ্চশিক্ষার প্রতি অনীহা সৃষ্টি এবং ক্লাস ও পরিক্ষার উপস্থিতি কমিয়ে দিয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে কমে যাচ্ছে শিক্ষার মান। এতে নৈতিক চরিত্রের পাশাপাশি মুল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। মাদক এখন তরুণ-তরুণীদের মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। তাদের কারণে ভুক্তভোগী পরিবারের অন্যান্য সদস্য। বিশেষত বাবা-মা। মাদকাসক্ত সন্তানের হাতে প্রাণ যাচ্ছে পিতা-মাতার। আর এসব ঘটনাকে ধরা হচ্ছে অধঃপতনের সর্বনিম্ন স্তর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদকের নীল ছোবলে কোমল হাত পরিণত হচ্ছে ভয়ঙ্কর খুনির হাতে। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, পারিবারিক কাঠামোর শিথিলতার কারণে সন্তানদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়া এবং এ সংক্রান্ত অপরাধগুলোর দ্রুত বিচার না হওয়ায় সমস্যা আরো বাড়ছে। ২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট মাদকাসক্ত কন্যা ঐশীর হাতে সস্ত্রীক পুলিশ কর্মকর্তা খুনের ঘটনা দেশবাসীকে নাড়া দেয়। ২০১২ সালের ১৪ মার্চ পুরান ঢাকায় ভাইয়ের হাতে ভাই খুন হয়। ২০১৩ সালের ১৩ মার্চ নাটোরের লালপুরে মাদকাসক্ত ছেলের শাবলের আঘাতে বাবা নিহত হয়। এরপর ২০১৪ সালে সিলেটের গোলাপগঞ্জে একই পরিবারের চারজনকে কুপিয়ে খুন করে মাদকাসক্ত সন্তান আব্দুস সালাম। সর্বশেষ দু’সপ্তাহ আগে গত ২৯ অক্টোবর রাজধানীর জুরাইনে মহর আলীকে গলা কেটে হত্যা করেছে তারই ছেলে সুমন (২৫)।সুমন পরিবারের অলক্ষ্যে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। জানাজানি হলে পরিবার থেকে তাকে পুর্নবাসনের জন্য ভারত পাঠানো হয়। কিন্তু চিকিৎসা শেষ হওয়ার আগেই সে দেশে ফিরে আসে ঘটনার তিন দিন আগে। বাবার সঙ্গে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে সে বাবার গলার ছুরি চালিয়ে দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই বাবার মৃত্যু হয়। সুমন পালিয়ে গেলেও তিনদিনের মাথায় কদমতলী থানার পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সে (সুমন) পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে সে বাবাকে হত্যার কথা স্বীকার করেছে। কিন্তু কি কারণে হত্যা করেছে তা অনেক জিজ্ঞাসাবাদেও বলছে না।’শুধু বাংলাদেশে নয়, মাদকাসক্ত সন্তানের হাতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও খুনের বহু নজির রয়েছে। ২০১২ সালের ২০ জুলাই জর্ডান রাইয়ান নামের এক কিশোরকে নেশা গ্রহণে বাঁধা দেওয়ায় তার বাবা মাকে যখম করে। মা বেঁচে গেলেও বাবা মারা যান। গত ১৩ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের আলবামায় জেসি হলটন নামের এক মাদকাসক্ত কিশোর তার বাবা-মাকে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়া, গত ২৮ অক্টোবর সৌদি আরবের তায়েফে বৃদ্ধ বাবা মাকে হত্যা করেছে ২৭ বছর বয়সী এক মাদকাসক্ত যুবক।বর্তমানে মাদকাসক্তদের সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে বেসরকারিভাবে বলা হয়, দেশে প্রায় ৮০ লাখের বেশি মাদকাসক্ত রয়েছে এবং মাদকসেবীদের মধ্যে ৮০ শতাংশই যুবক, তাদের ৪৩ শতাংশ বেকার। এদের ৫০ শতাংশ অপরাধের সঙ্গে জড়িত রয়েছে।সন্তানের এমন বিগড়ে যাওয়ার দায়ভার সম্পূর্ণ অভিভাবকের বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা । তারা বলছেন, অভিভাবক মনে করেন প্রচুর সম্পদ অর্জন করে সন্তানকে সুখী করা যাবে। কিন্তু সন্তানের বেড়ে ওঠার সময় বাবা–মায়ের কাছে যে সময় পাওয়ার কথা, তারা সন্তানদের সেই সময় দিচ্ছে না। এর বিপরীতে সন্তানরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা পয়সা পাচ্ছে। এই টাকা সে খরচ করছে মাদকের পেছনে। যখন অভিভাবক বুঝতে পারেন তাদের সন্তান মাদকাসক্ত, তখনও তারা তাকে সময় না দিয়ে চিকিৎসার জন্য কোন পূর্ণবাসন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেন। টাকা পয়সা দেওয়া বন্ধ করে দেন। এতে হীতে বিপরীত হয়। আবেগের বশবর্তী হয়ে সন্তানরা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে যায়।বিশ্লেষকরা বলছেন, যাদের বেড়ে উঠা সঠিকভাবে হয়নি তাদের মাদকাসক্ত হওয়ার সম্ভবনা বেশি থাকে। আর আসক্ত হয়ে গেলে তাদের মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে যায়। তারা ভাল-মন্দ বিচারের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তখন তাদের যা মন চায় তাই করে। এই সময়টাতে তারা তাদের বাবা-মাকেও হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করে না।এ বিষয়ে মনোবিজ্ঞানী ড. নাসরিন ওয়াদুদ বলেন, ‘বাবা-মা এসব ঘটনার দায় এড়াতে পারে না। কারণ সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কি করছে, এটা বাবা-মার লক্ষ্য রাখা উচিত।’ড. নাসরিন ওয়াদুদ বলেন, ‘ঐশীর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। বাবা-মা ওকে সময় দেয়নি। এ জন্য সে ভুল পথে হেঁটেছিল। যখন বাবা মা জানতে পারল যে, তাদের মেয়ে নেশাগ্রস্থ তখন তারা তাকে ভালবাসা দিয়ে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেননি। সন্তানের প্রতি অবহেলা দেখিয়েছেন। এ জন্য সে জন্মদাতাদের হত্যার মতো ঘটনা ঘটিয়েছে।’তিনি বলেন, ‘সুমনের প্রেক্ষাপটও ঠিক এমনই । বাবার প্রচুর টাকা আছে। সে যখন যা চেয়েছে তখনই তা পেয়েছে। এই পাওয়ার মধ্যে সে যে কখন নেশার জগতে পৌঁছেছে তা হয়তো বুঝতে পারেনি। বাবা মা বিষয়টি বুঝতে পেরে তাকে ভালবাসা বা যত্ন করে সঠিক পথে ফিরিয়ে না এনে ভারতে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছিলেন। টাকা খরচ করে তারা মানসিক বিকারগ্রস্থ সন্তানকে সমাজে আড়াল করতে চেয়েছিলেন। ওদের উচিত ছিল সন্তানকে বাইরে না পাঠিয়ে দেশে কোনো পুর্নবাসন কেন্দ্রে রাখা। নিজেদের দায়িত্বে সুস্থ্য স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা। ’এসব ঘটনা অন্য বিপথগামীদেরও উৎসাহী করে কী না? জানতে চাইলে এ মনোবিজ্ঞানী বলেন, ‘একটি ঘটনা দেখে অন্য কারো উৎসাহিত হওয়ার বিষয় খু্বই ক্ষীণ। নেশাগ্রস্থদের চিন্তাভাবনা এলোমেলো থাকে। তাদের বোঝা মুশকিল। বিশেষ করে বাবা মা হত্যার ক্ষেত্রে। এটা জেনারালইজ করা যাবে না যে, ওরা যা করেছে তা দেখে অন্যরা উৎসাহিত হবে।’ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের মনোবিজ্ঞানী ড. কামাল উদ্দীন বলেন, ‘এসব ঘটনা মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা থেকে হয়। যখন মানুষের মস্তিষ্ক দূর্বল হয়ে যায় তখন পুরাতন ঘটনা অনুসরণ করার মতো অবস্থা থাকে না। একটা ঘটনা থেকে যে আরেকটা ঘটনা ঘটে তা বলা যাবে না, তবে পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে।’অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দীন আরো বলেন, বাবা-মাকে হত্যা করার মতো ঘটনা আমাদের দেশে খুবই কম। যারা করছে তারা মাদকাসক্ত। তারা মনস্তাত্ত্বিকভাবে সমস্যাগ্রস্ত। এ জন্য ঐশী বা সুমনের দ্বারা এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান বলেন, ঐশী বা সুমনের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তা অপ্রত্যাশিত। তবে এর দায় কিছুটা অভিভাবকদেরও। তারা যদি সন্তানের প্রতি আরো যত্নশীল হলে সন্তানরা মাদকাসক্ত হতো না। অপ্রত্যাশিত ঘটনাও ঘটতো না।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম মনে করেন, সঠিকভাবে বেড়ে না ওঠায় কিছু ছেলেমেয়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে। এদের মধ্যে যারা মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে তারাই বাবা-মা হত্যার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে।তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনা দেখে অন্যরা উৎসাহিত বা প্রভাবিত হতে পারে। এর বড় কারণ দেশে আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব। অপরাধীরা একটা অপরাধ করার আগে প্রথমে কয়েকটি বিষয় ভাবে। তার মধ্যে অন্যতম হলো- আগে এ জাতীয় ঘটনায় কি বিচার হয়েছে। যা তাদের প্রভাবিত করে।