একাত্তলাইভ ডেস্ক: খাদিজা বেগম নার্গিস । গত সোমবার দুপুর পর্যন্ত যিনি ছিলেন সুস্থ ও স্বাভাবিক। তিনি এখন রয়েছেন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তার বেঁচে থাকার জন্য এখন ভরসা শুধু ওপরওয়ালাই।গত সোমবার খাদিজা কলেজে গিয়েছিলেন পরীক্ষা দিতে । পরীক্ষাও শেষ করলেন। ফিরছিলেন বাড়ি। কিন্তু বাড়ি ফেরা হলো না তার। শিকার হলেন বখাটে বদরুলের হামলার। ধারালো অস্ত্র দিয়ে বদরুল তাকে নির্মমভাবে কুপিয়েছে।তাকে উদ্ধার করে সিলেটে ওসমানী হাসপাতালে নেওয়া হয়। সিলেট থেকে মঙ্গলবার আনা হয় রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে। এখানে দ্বিতীয় দফায় তার মাথায় অস্ত্রোপচার করা হয়। এখন তিনি আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। আর বাইরে তার স্বজনরা আশায় বুক বেঁধে আছেন, সুস্থ হয়ে সবার মাঝে ফিরে আসবে খাজিদা।চিকিৎসকরা এখন পর্যন্ত শোনাচ্ছেন না কোনো আশার বাণী। তারা ৭২ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখার কথা বলেছেন। ইতিমধ্যে সেই সময়ের অর্ধেকেরও বেশি পেরিয়ে গেছে। কিন্তু অবস্থার উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই। তাই খাদিজার স্বজনরা মনে করছেন, তার বেঁচে থাকার জন্য ওপরওয়ালাই এখন ভরসা। শুধু স্বজনরা না, যারা খাজিদার কথা শুনেছেন, তারা সকলেই তাকিয়ে আছেন ওপরওয়ালার দিকে।স্কয়ার হাসপাতালে খাদিজার সঙ্গে আছেন তার চাচা ও মামা। খাদিজার চাচা আব্দুল কুদ্দুস বলেন, চিকিৎসকরা তাকে পর্যবেক্ষণে রেখেছেন। এখনো সুস্থতার ব্যাপারে তারা কিছু বলেননি। চিকিৎসকরা বলছেন, ‘মেয়েটি যেহেতু জীবনের সঙ্গে ফাইট করে এতদূর আসতে পেরেছে, সেহেতু আমরা একটু আশায় বুক বাঁধতে পারি।’কুদ্দুস বলেন, ‘যত উন্নত চিকিৎসা দরকার আমরা খাদিজাকে তা দেব। এখন ওপরওয়ালাই ভরসা। তিনি যদি চান তাহলে আমার ভাতিজি সুস্থ হবে। আমার ভাতিজির জন্য দেশবাসীকে দোয়া করার অনুরোধ জানাই।’ঘটনার দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘সোমবার বিকালে হঠাৎ আমি একটা ফোন পাই। ওপাশ থেকে মেয়ে কণ্ঠে কেউ আমাক বলছে আপনার ভাতিজিকে একজন ‘ছেট’ (কোপ) মারছে। তখন আমি দিশেহারা হয়ে পড়ি। ভেবে পাচ্ছিলাম না কি করব। পরে হাসপাতালে এসে দেখি ডাক্তাররা তার অপারেশন করছেন। ওই রাতে সিদ্ধান্ত নিই খাদিজাকে ঢাকায় বড় কোনো হাসপাতালে নিয়ে আসব। কিন্তু তাৎক্ষণিক বিমানের ফ্লাইট বা এয়ার অ্যাম্বুলেন্স না পাওয়ায় একটি সাধারণ অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হই।’খাদিজার চাচা আরো বলেন, ‘আমার ভাতিজিরে একটা ফুয়ায় (ছেলে) রাস্তার মাঝে ছেদাইল (কুপিয়েছে)। কিন্তু এগু (একজন) মানুষ ও সামনে আইলনা। পরে এগু ছোট ফুয়ায় তারে উদ্ধার করি লইয়া (নিয়ে) আয় (আসল)।’খাদিজাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা ছেলেটির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি ওই ছেলের কাছে কৃতজ্ঞ। আমি দেখেছি খাদিজার রক্তে তার শরীর ভিজে গিয়েছিল। সে সাহস করে তাকে উদ্ধার করেছে। রক্তও দিয়েছে। তাকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা আমার নেই। আল্লাহ ছেলেটারে অনেক বড় করুক।’ আব্দুল কুদ্দুস বলেন, ‘কিতা দুষ (কি অপরাধ) ছিল আমার ভাতিজির। কেন ইলান (এভাবে) তারে অমানবিক নির্যাতন করা হলো। আমি আল্লাহর কাছে বিচার চাই। আর সরকারের কাছ অনুরোধ অপরাধীর যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হয়।’খাদিজার আরেক চাচা আব্দুল আলীম বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে খাদিজার চিকিৎসার জন্য সর্বোচ্চ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখন আল্লাহ সহায় হলে আমরা হয়তো খাদিজাকে আমাদের মাঝে জীবিত পাব। এ জন্য সবার সহযোগিতা ও দোয়া দরকার।’খাদিজার বড় ভাই শাহীন আহমদ চীনে চিকিৎসা বিজ্ঞানে পড়ালেখা করছেন। আব্দুল কুদ্দুস জানান, শাহীন বৃহস্পতিবার চীন থেকে ঢাকায় আসবেন। অন্যদিকে আগামী শুক্রবার খাদিজার বাবা মাসুক মিয়া সৌদি আরব থেকে ঢাকায় আসবেন। খাদিজা পরিবারের একমাত্র মেয়ে। তারা তিন ভাই ও এক বোন। মেজো ভাই নূর আহমদ সিলেট বিজ্ঞান কলেজ এবং ছোট ভাই স্থানীয় একটি সরকারি মাদ্রাসায় চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে।বুধবার রাত পর্যন্ত খাদিজাকে ১৪ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সিলেটে ১০ ব্যাগ ও স্কয়ার হাসপাতালে চার ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে। তার রক্তের গ্রুপ ‘এ পভিটিভ’।খাদিজাকে রক্ত দিতে আসা সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার ছেলে ও ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভের প্রাক্তন শিক্ষার্থী মৃদুল হাসান বলেন, ‘এভাবে একটা মেয়েকে নির্মম নির্যাতন কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। অপরাধী এখনো পুলিশের হেফাজতে রয়েছে। আমাদের দাবি থাকবে তার যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়।’তিনি বলেন, ‘দিন দিন আমাদের ভেতর থেকে মানবিকতা হারিয়ে যাচ্ছে। মানবিকতার এত অধঃপতন হয়েছে যে, রাস্তায় একটা মেয়েকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করতেও দ্বিধাবোধ করেনি ওই যুবক। তাকে শাস্তির মাধ্যমে একটা দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হওয়া দরকার। এতে করে নারী নির্যাতন কমবে।’জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের প্রাক্তন সদস্য সৈয়দা জেবুন্নেছা হক খাদিজাকে দেখতে এসে বলেন, ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ও সম্প্রীতির অঞ্চল হলো সিলেট। সেখানে রাস্তায় প্রকাশ্যে নারীকে কোপানোর ইতিহাস নেই বললেই চলে। বদরুল এ ঘটনা ঘটিয়ে ওই অঞ্চলের শান্তি নষ্ট করার চেষ্ট করেছে। এ জন্য তার শাস্তি হওয়া দরকার।তিনি বলেন, ‘আমি প্রথমে নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারিনি এমসি কলেজ প্রাঙ্গণে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। তবে এ ঘটনায় কলেজ কর্তৃপক্ষের কোনো গাফিলতি আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে সরকারকে অনুরোধ জানাব।’সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শামীমা শাহরিয়ার বলেন, খাদিজা পরীক্ষা দিতে এমসি কলেজে গিয়েছিল। সাধারণত পরীক্ষা কেন্দ্রে বহিরাগতদের প্রবেশের কোনো অধিকার থাকে না। সেখানে ঢুকে খাদিজাকে কোপানোয় তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন।সোমবার সিলেটের মুরারী চাঁদ (এমসি) কলেজের পুকুরপাড়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযু্ক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা বদরুল আলম অমানবিকভাবে খাদিজাকে কুপিয়ে জখম করে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।খাদিজার শরীরের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষত মাথার আঘাত ছিল গুরুতর। ওই হাসপাতালে মাথায় প্রথম দফা অস্ত্রোপচারের পর সোমবার দিবাগত রাতে তাকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে আসে তার পরিবার। মঙ্গলবার বিকেলে স্কয়ার হাসপাতালে তার দ্বিতীয় দফা অস্ত্রোপচার করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।এদিকে খাদিজার ওপর বর্বর হামলার ঘটনায় ছাত্রলীগ নেতা বদরুল আলমের ফাঁসির দাবিতে সিলেটসহ সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় বইছে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন খাদিজার সুস্থতা ও বদরুলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।খাদিজার সহপাঠীরা চাইছেন বদরুলের শাস্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে নারী শিক্ষার্থীদের জীবনের নিরাপত্তা ফিরে আসুক। এভাবে আর যেন কোনো খাদিজা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে না দাঁড়ায়।