অনলাইন ডেস্ক: রমজান হলো সিয়াম ও কিয়ামের মাস। কোরআন নাজিলের মাস। রহমতের মাস। জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের মাস। রমজানের জীবনযাত্রা অন্যসব মাসের মতো নয়। রহমত, বরকত, মাগফিরাতের মাস রমজান। প্রত্যেক রোজাদার এটা বিশ্বাস করেন। এ মাসে মানুষ একটু শান্তিতে থাকতে চায়। কিন্তু শান্তি কোথায়? রমজান মাসকে সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পায়। তবে শুধু রমজাননির্ভর পণ্য নয়, সব পণ্যেরই দাম বাড়ে। মাছ, মাংস, তরকারির দাম নাগালের বাইরে চলে যায়। মানুষের আয় বাড়ে না, শুধু ব্যয় বাড়ে। এর ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহে মানুষ হিমশিম খায়। পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কথা বলা হয়। এ কথাটি সবসময় সঠিক হয় না। সব সময় আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে না। মূলত পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। পাইকারি বাজারে কোনো পণ্যের দাম বাড়লে খুচরা ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম তিন-চারগুণ বাড়িয়ে দেবে, এটাই স্বাভাবিক।
নিয়ন্ত্রণ করবে কে : বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, পণ্যের আমদানি পর্যাপ্ত। পণ্যের জোগানেও কমতি নেই। যদি তাই হয়, তাহলে এই মূল্যবৃদ্ধি নিঃসন্দেহে অনৈতিক। যারা এটা করছেন, তাদের ধরা হচ্ছে না কেন? রমজান মাস এলেই সাধারণ মানুষ বা দেশবাসী দুটো বিষয়ের মুখোমুখি হয়। এক. নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধি এবং দুই. ব্যবসায়ীদের নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত মুনাফা অর্জনের লোভ। অথচ এ দুটি বিষয়ই রমজানের মূল স্পিরিট বা শিক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ বছরও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সরকারের তরফ থেকে নানা উদ্যোগ, হুমকিধমকি সত্ত্বেও রোজার মাসে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি।
খাঁড়ার ঘা : রমজানের আগে হাওরাঞ্চলে অকাল বন্যা, রমজান শুরুর দুদিন পরই ঘূর্ণিঝড় মোরা, রমজান শুরুর চার দিন পরই বড় বাজেটে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের মানুষের স্বপ্ন, আশা সব চুরমার হয়ে যায়। রমজান মাসে আমরা সবাই চেষ্টা করি ভালো খাওয়া-দাওয়া, নানা রকম নেকির কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার। কিন্তু নানা সমস্যা ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জাঁতাকলে পড়ে মানুষের কষ্ট যায় বেড়ে। তবে শুধু দাম বাড়িয়েই ক্ষান্ত হয় না অসৎ ব্যবসায়ীরা। তারা একইসঙ্গে পণ্যে ভেজালসহ নানাভাবে ক্রেতাদের হয়রানির পথ বেছে নেয়। এতে করে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘার মতো সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় নাভিশ্বাস ওঠে। স্বভাবতই সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যয় ও দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এবারের পবিত্র রমজান মাস। এ দুর্ভোগের সঙ্গে নগর ও শহরাঞ্চলের অগণিত মানুষ আরো একটি দুর্ভোগের শিকার হন। সেটি হচ্ছে যানজট। রমজান শুরু হলে যানজট নতুন মাত্রা পায়। কারণ এ সময়ে অফিস-আদালত ও কেনাকাটার জন্য সবচেয়ে বেশি মানুষ একসঙ্গে রাস্তায় নেমে পড়ে। ফলে রাস্তায় যেমন মানুষের ভিড়, তেমনি ভিড় বাড়ে যানবাহনের। এটা যেন আজ একটা নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাজনীতির অশুভ ফসল : পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি একটি ভয়াবহ ব্যাধি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যাকে আমরা রাজনীতির অশুভ ফসল হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি। এর প্রত্যক্ষ শিকার যেমন পরিবহন মালিক শ্রমিকরা, তেমনি এর পরোক্ষ ভুক্তভোগী গোটা দেশবাসী। চাঁদাবাজির কারণে বাড়ছে পরিবহন ভাড়া। সরাসরি চাপ পড়ছে যাত্রীদের ওপর। অন্যদিকে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বেড়ে যাচ্ছে পণ্যমূল্যও। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাজারে। আর এই চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে পরিবহন সেক্টরে মাঝে মাঝেই সৃষ্টি হচ্ছে অস্থিতিশীলতা, উত্তেজনা, সংঘাত-সহিংসতা।
উপসংহার : এবার ১৮ রোজা হতে আষাঢ় মাস শুরু, অর্থাৎ বর্ষাকাল। কিন্তু চৈত্রের প্রথম সপ্তাহ হতে যে বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছিল তা এখনো পর্যন্ত অব্যাহত আছে। তবে মাঝে মাঝে গ্রীষ্মের কষ্ট দেশবাসীকে পোহাতে হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বর্ষার চাপ ও জলাবদ্ধতায় জনগণকে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়তে হয়। এদিকে বঙ্গোপসাগরে নিম্ন চাপের সৃষ্টি হলে গত কয়েক দিনের বৃষ্টি ও পাহাড়ধসের ঘটনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সেনাসহ শতাধিক মানুষ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। বহু এলাকা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই।
রোজার ও ঈদের মাসে বাংলাদেশের বাজারে আগুন লাগে যতই বর্ষাকাল হোক। এই আগুন কিসের তা সবাই জানেন। যেমন-চিনির মিষ্টি ও চালের বাজারে আগুন, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পেঁয়াজ, লবণ, খেজুর, ডাল, বেগুন, আদা, আটা, ময়দা, মাংস ও নিত্যপণ্য দ্রব্যের মূল্য। যেসব এলাকায় রমজান মাসে ছেলে বা মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতারি এবং জ্যৈষ্ঠ মাসে আম-কাঁঠাল দেওয়ার প্রচলন আছে, তারা যদিও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে একত্রে দুটোই দিচ্ছেন, তারপরও তাদের জন্য সব কিছু বিষফোঁড়ার মতো মনে হচ্ছে। যে ব্যক্তির আয়ের ওপর সবকিছু নির্ভর এবং যে ব্যক্তি বাজারের স্লিপ নিয়ে বাজার করেন, তিনিই বোঝেন কত ধানে কত চাল।
সবকিছু ছাপিয়ে রমজান শেষে সন্ধ্যাকাশে ঈদের বাকা চাঁদ দেখামাত্রই মুসলমানরা ঈদের আগমনবার্তায় উল্লসিত হয়ে ওঠেন। কবি নজরুলের দারুণ শ্রুতি সুখকর ঈদের গানটি সব ধরনের প্রচার মাধ্যমে বেজে ওঠে বলে দেয় ঈদের আগমনী বার্তা। গানের অপূর্ব মূর্ছনায় সবাই বিমোহিত হয়ে ভুলে যান বিগত ৩০ দিনের অসহনীয় কষ্টের কথা। মূলত এই শ্রুতিমধুর গানটির মধ্যে একটি সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক চিন্তাধারার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। কারণ, গানটির বিরাট অংশজুড়ে ইসলামের শাশ্বত সৌন্দর্য ও জাকাতভিত্তিক অর্থনীতির স্বপক্ষে বলিষ্ঠ বক্তব্য লক্ষণীয়ভাবে ফুটে উঠেছে।
এক মাস সিয়াম সাধনার পর বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা পালন করবে ঈদ। ঈদ কেবল সিয়াম সাধনার ফলই নয়, বিশ্বমানবতার এক মহামিলন মেলা। ত্যাগ, সহনশীলতা, বিনয় আত্মসংযম ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করার এক মহান শিক্ষা পবিত্র মাহে রমজান ও ঈদ পালনের মধ্যে। বাংলাদেশে ঈদ কেবল মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব নয়, ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে এটা এখন সর্বজনীন মিলন উৎসবে পরিণত হয়েছে। এটি বাঙালি সংস্কৃতিরও একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। ঈদ ধনী গরিবের মধ্যকার ব্যবধান ভুলিয়ে দিয়ে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে দেয়। সাম্য ও সৌহার্দ্যের এক উজ্জ্বল প্রতীক হচ্ছে এই ঈদ। ঈদ রচনা করে পারিবারিক ও সামাজিক আত্মীয়তার মেলবন্ধন।
ঈদের শাব্দিক অর্থ আনন্দ হলেও আমাদের সমাজে ঈদ মানে হচ্ছে এক নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা, কার কত অর্থের দাপট আছে তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা। এ প্রতিযোগিতায় যারা জয়ী হয়, ঈদের বাকা চাঁদ তাদের জন্য আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। আর যারা হেরে যায়, তাদের কাছে ঈদের বাঁকা চাঁদকে নিছক গলাকাটা ছুরি বলে ভ্রম হয়। তবু বলতে হয়, ঈদুল ফিতর প্রত্যেকের জীবনে মঙ্গলময় বার্তা নিয়ে আসুক। অতীতের গ্লানি ও হতাশা ঝেড়ে ফেলে সাবাই সুখ ও সমৃদ্ধময় জীবনে পা বাড়াক। ঈদ সবার জন্য আনন্দের ঝরনাধারা বয়ে আনুক, প্রতিটি মানুষের মুখে ফুটে উঠুক আনন্দের হাসি। এটাই আমাদের প্রত্যাশা।