আদর্শ যুবক মুহাম্মদ (সা.)

একাত্তর লাইভ ডেস্ক:
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) যেমন ছিলেন ইনসানে কামেল তথা পরিপূর্ণ মানুষ, তেমনই ছিলেন একজন পরিপূর্ণ আদর্শ যুবক। পৃথিবীতে যত ভালো গুণ আছে এর সব গুণের সমাবেশ ঘটেছিল হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর মধ্যে। এককথায়, তিনি ছিলেন সর্বগুণের আধার। ফরাসি লেখক আলফ্রেড তার তুর্কির ইতিহাসের প্রথম খ-ে লিখেছেন, ‘দার্শনিক, বক্তা, ধর্ম প্রচারক, যোদ্ধা, আইন রচয়িতা, ধর্মমতের ও প্রতিমাবিহীন ধর্ম পদ্ধতির সংস্থাপক মুহাম্মদ (সা.) কে মানুষের মহত্ত্বের যতগুলো মাপকাঠি আছে তা দিয়ে মাপলে, কোনো লোক তাঁর চেয়ে মহৎ হতে পারবে না।’
মহামানব মুহাম্মদ (সা.) যৌবনে পদার্পণ করে চরম নোংরা পরিবেশে লালিত-পালিত হয়েও নিজের যৌবনকে কলঙ্কমুক্ত রাখতে সক্ষম হন। যে সমাজে অবৈধ প্রেম, কুদৃষ্টি বিনিময় ও ব্যভিচার যুবকদের জন্য ছিল গর্বের ব্যাপার, সে সমাজে এ অসাধারণ যুবক নিজের দৃষ্টিকেও কলুষিত হতে দেননি। যেখানে অলিগলিতে ছিল মদ তৈরির কারখানা এবং ঘরে ঘরে ছিল পানশালা, বসত মদ্যপানের জমজমাট কবিতা পাঠের আসর, সেখানে এ যুবক এক ফোঁটা মদও মুখে তোলেননি। যেখানে জুয়া জাতীয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল, সেখানে আপাদমস্তক পবিত্রতায় ম-িত এ যুবক জুয়া স্পর্শও করেননি। নষ্ট গানবাজনা যেখানে সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেখানে তিনি এসব অপসংস্কৃতির ধারেকাছেও ঘেঁষেননি। কোনো কারণে একবার যদিও এ ধরনের অনুষ্ঠানে যেতে হয়েছিল, কিন্তু যাওয়ামাত্রই তার এমন ঘুম পায় যে, সেখানকার কোনো অনুষ্ঠানই তার আর দেখা ও শোনার সুযোগ হয়ে উঠেনি।
যে বয়সে ছেলেরা সাধারণত বিপথগামী হয়ে থাকে, ঠিক সেই বয়সেই তিনি গরিব ও নিপীড়িত মানুষদের সহায়তা এবং অত্যাচারীদের জুলুম উচ্ছেদের লক্ষ্যে ‘হিলফুল ফুজুল’ নামে একটি সংস্কারকামী সংগঠন গড়ে তোলেন। নবুওয়ত লাভের পর রাসুল (সা.) ওই সংগঠনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলতেন, ‘ওই অঙ্গীকারের পরিবর্তে কেউ যদি আমাকে লাল রঙের উটও দিত, তবু আমি তা থেকে ফিরে আসতাম না। আজও কেউ যদি আমাকে তেমন কোনো চুক্তি সম্পাদন করতে ডাকে, তবে আমি সেজন্য প্রস্তুত।’
তিনি জীবনসঙ্গিনী নির্বাচন করার সময় মক্কার উঠতি যৌবনা সুন্দরী মেয়েদের দিকে ভ্রƒক্ষেপ না করে চল্লিশোর্ধ্ব বয়সের মহিলা হজরত খাদিজা (রা.) কে বিয়ে করেন। খাদিজা (রা.) ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের একজন সতীসাধ্বী  মহিলা। বিয়ের জন্য এমন পাত্রী নির্বাচন তাঁর মানসিকতা ও স্বভাব-চরিত্রের গভীরতাকেই ফুটিয়ে তোলে।
কোনো ব্যক্তির চরিত্র ও মানসিকতাকে তাঁর বন্ধুবান্ধব ও সহচরদের দেখে যাচাই করা যায়। আবু বকর (রা.) এর সঙ্গেই ছিল তাঁর সবচেয়ে গভীর বন্ধুত্ব ও অকৃত্রিম সম্পর্ক। একে তো সমবয়সী, তদুপরি সমমনা। তার অপর এক বন্ধু ছিলেন খাদিজার চাচাতো ভাই হাকিম বিন হিজাম। তিনি হারাম শরিফের একজন খাদেম ছিলেন। দিমাদ বিন সালাবা আজদি নামক একজন চিকিৎসকও ছিল তার অন্যতম বন্ধু। যুবক মুহাম্মদ (সা.) এর বন্ধুমহলে একজনও নীচ, হীন, জুলুমবাজ ও পাপাচারী লোক দেখা যায়নি।
তিনি যখন অর্থোপার্জনে পদার্পণ করলেন, তখন বাণিজ্যের ন্যায় পবিত্র ও সম্মানজনক পেশা বেছে নিলেন। দেশের বড় বড় পুঁজিপতি এ যুবককে তাদের পুঁজিগ্রহণ ও বাণিজ্য করার জন্য মনোনীত করে। এ যুবকের মধ্যে এমন গুণ নিশ্চয়ই ছিল যেজন্য তারা তাঁকে মনোনীত করেছিল। খাদিজা (রা.) এবং আরও কয়েক ব্যক্তি একে একে তাঁর অনুপম সততার বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করে এবং তারা সবাই তাঁকে একবাক্যে ‘তাজেরে আমিন’ বা ‘সৎ ব্যবসায়ী’ উপাধিতে ভূষিত করেন। আবদুল্লাহ বিন আবিল হামসার সাক্ষ্য আজও সংরক্ষিত রয়েছে, নবুওয়তের আগে একবার এ তরুণ সৎ ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার কথা হয় যে, আপনি এখানে দাঁড়ান, আমি আসছি। কিন্তু পরে সে ভুলে যায়। তিন দিন পর ঘটনাক্রমে আবদুল্লাহ সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পান, ওই সৎ ব্যবসায়ী নিজ প্রতিশ্রুতির শেকলে আবদ্ধ হয়ে সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। হজরত মুহাম্মদ (সা.) আবদুল্লাহকে বললেন, ‘তুমি আমাকে কষ্ট দিয়েছ। আমি তিন দিন ধরে এখানে দাঁড়িয়ে আছি।’ (আবু দাউদ)।
কাবা শরিফ সংস্কারের সময় হাজরে আসওয়াদ পুনঃস্থাপন নিয়ে কোরাইশদের মধ্যে তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এটা এতদূর গড়ায় যে, তলোয়ার পর্যন্ত বেরিয়ে পড়ে এবং সাজ সাজ রব পড়ে যায়। কিন্তু এ গোলযোগ মিটমাট করার সুযোগটা যুবক মুহাম্মদই (সা.) লাভ করেন। চরম উত্তেজনার মধ্যে শান্তির পতাকাবাহী এই বিচারক একটা চাদর বিছিয়ে দেন এবং নিজ হাতে চাদরের ওপর রেখে দেন হাজরে আসওয়াদ। এরপর তিনি কোরাইশ গোত্রের সব শাখার প্রতিনিধিকে চাদরের চারপাশে ধরে হাজারে আসওয়াদ যথাস্থানে নিয়ে যেতে আহ্বান জানান। পাথর যথাস্থানে উপনীত হলে যুবক মুহাম্মদ (সা.) পাথরটা তুলে যথাস্থানে স্থাপন করলেন। এরপর গোলযোগ থেমে গেল এবং সবার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
যুবক মুহাম্মদ (সা.) সাংসারিক, ব্যবসায়িক ও অন্যান্য দুনিয়াবি ব্যস্ততা থেকে মুক্ত হয়ে যখন কিছু সময় অবসর পেতেন, তখনও তিনি আমোদ-ফুর্তি ও বিনোদনে কাটাতেন না। যত্রতত্র ঘোরাঘুরি করে, আড্ডা দিয়ে কিংবা অলসভাবে ঘুমিয়ে কাটাতেন না। বরং সব হৈ-হাঙ্গামা থেকে দূরে সরে এবং সব কর্মব্যবস্ততা পরিহার করে নিজের নির্মল ও নিষ্কলুষ সহজাত চেতনা এবং বিবেকের নির্দেশক্রমে হেরা গুহার নিভৃত প্রকোষ্ঠে গিয়ে এক আল্লাহর ইবাদত করতেন।
বিশ্বজগতের প্রচ্ছন্ন মহাসত্যকে হৃদয়ঙ্গম করা ও মানব জীবনের অদৃশ্য রহস্যগুলো জানার জন্য আপন সত্তায় ও বিশ্ব প্রকৃতির অতলান্তে চিন্তা গবেষণা চালাতেন। তিনি ভাবতেন, কীভাবে নিজ দেশবাসী ও গোটা মানবজাতিকে নৈতিক হীনতা ও নীচতা থেকে টেনে তুলে আদর্শবান  করা যায়।
দৈনন্দিন জীবনের এ জাতীয় ঘটনাবলি নিয়ে ভবিষ্যতের বিশ্বনবী কোরাইশদের চোখের সামনেই পবিত্র সময় কাটতে থাকে। খোদ কোরাইশরাই তাঁকে সাদেক (সত্যবাদী), আল-আমিন (বিশ্বাসী), তাজেরে আমিন (সৎ ব্যবসায়ী), আমানতদার, জ্ঞানী-গুণী ও মহৎ চরিত্রধারী মানুষ বলে বারবার স্বীকার করেছে। তাঁর শত্রুরা কঠিনতম দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্যেও তাঁর মনীষা ও নৈতিকতার শ্রেষ্ঠত্বের সাক্ষ্য দিয়েছে।
জর্জ বার্নার্ড শ লিখেছেন, ‘যদি সমগ্র বিশ্বের ধর্ম, সম্প্রদায়, আদর্শ ও মতবাদসম্পন্ন মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে কোনো নায়কের শাসনাধীনে আনীত হতো, তা একমাত্র মুহাম্মদই (সা.) সর্বাপেক্ষা সুযোগ্য নেতারূপে তাদের শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করতে পারতেন।’ সর্বোপরি আল্লাহ তায়ালা তো পবিত্র কোরআনে তাঁর সম্পর্কে বলেছেনই, ‘নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহ (সা.) এর মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ।’