একাত্তরলাইভডেস্ক: বিশ্বব্যাপী মানিলন্ডারিং ও অর্থনৈতিক দুর্নীতি বিশ্বের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। অর্থনৈতিক দুর্নীতি ও মানিলন্ডারিং বন্ধে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন।উঁচু পর্যায়ের রাজনীতিসংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক দুর্নীতি ও মানিলন্ডারিং বন্ধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোকে একটি আইনি দায়বদ্ধতার মধ্যে নিয়ে আসার জন্য শক্তিশালী আইনি কাঠামো প্রণয়ন ছাড়া উপায় নেই। এ বিষয়ের আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামো কেমন হওয়া উচিত- তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মতামতের জন্য বিশ্বব্যাংক আয়োজিত এক সেমিনারে এমন মত প্রকাশ করেছেন অর্থনৈতিক দুর্র্নীতি ও মানিলন্ডারিং বিষয়ের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা। উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাপী মানিলন্ডারিং এবং অর্থনৈতিক অপরাধের সুবিচারে একটি আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামো তৈরির লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্সি এবং গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির যৌথ উদ্যোগে শুক্রবার বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরে ‘এম্পলিফাইং ইন্টিগ্রিটি ইন দ্য ফাইট এগেইনস্ট সিস্টেমেটিক করাপশন’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির অন্যতম সিভিল সোসাইটি পার্টনার হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে নিউ ইয়র্ক থেকে অংশ নেন ‘ইন্টারন্যাশনাল কমিটি এগেইনস্ট ফিনান্সিয়াল ক্রাইমস ইন বাংলাদেশ’-এর মুখপাত্র ও পরিচালক (রিসার্চ) কাউসার মুমিন।সেমিনারের সূচনা বক্তব্যে গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির প্রেসিডেন্ট রেমোন্ড ব্যাকার বলেন, ডেমোক্রেটিক-ক্যাপিটালিস্ট সিস্টেম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আর মানিলন্ডারিং ও অর্থনৈতিক অপরাধের কারণে পুরো মতবাদটি-ই এখন একটি সিস্টেমেটিক রিস্কের মধ্যে পড়েছে। এর প্রতিকারে আমাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।রেমোন্ড ব্যাকার আরও বলেন, গণতন্ত্র এবং পুঁজিবাদকে রিব্যালেন্স করা একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে, বর্তমানে বিশ্বের ১১ বিলিয়ন মানুষ আয়, সম্পদ ও সুযোগের বিবেচনায় মারাত্মকভাবে বিভক্ত। এই বিভক্তি ও পার্থক্য সমাধানে যদি এখনই আমরা উদ্যোগ না নিতে পারি তাহলে আগামী শতকে ডেমোক্রেটিক-ক্যাপিটালিস্ট সিস্টেম অকার্যকর হয়ে পড়বে। আর, এ উদ্দেশে প্রথমেই ‘গ্লোবাল শ্যাডো অর্থনীতি’র ভিতকে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। কারণ, শ্যাডো অর্থনীতি যে পরিমাণ অর্থ জেনারেট করে তার বেশির ভাগই উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে পাচার হয়। আলোচনায় কার্নেগি এন্ডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর ‘ডেমোক্রেসি অ্যান্ড রুল অফ ল’ বিভাগের সিনিয়র গবেষক সারাহ কায়েস বলেন, অর্থনৈতিক দুর্নীতি যে কেবল সামাজিক ভঙ্গুরতারই সৃষ্টি করে তা নয়; বরং এর ফলে শক্তিশালী উগ্রপন্থা জন্ম লাভ করে। যখন কোনো সমাজে সুশাসনের অভাবজনিত দুর্নীতি বিরাজ করে তখন আইনের শাসনের প্রতি কিংবা সম্পদের সুরক্ষিত অধিকারের প্রতি মানুষের আগ্রহ লোপ পায়, মানুষ তখন এক ধরনের আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির নামে রেডিক্যাল মতাদর্শে বিশ্বাস স্থাপন করে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার প্রসঙ্গটি আলোচনায় টেনে ‘থিভস অফ দ্যা স্টেট : হোয়াই করাপশন্স থ্রেটেন গ্লোবাল সিকিউরিটি’ গ্রন্থের লেখিকা সারাহ কায়েস আরো বলেন, নির্বাচনের আগের এক জরিপে প্রতি ১০ জনের ৭ জন আমেরিকান বলেছেন, তারা টেররিজমের চেয়ে ওয়াশিংটনে রাজনীতিবিদদের দুর্নীতিপরায়ণতাকে বড় নিরাপত্তা হুমকি বলে মনে করেন। আর জনগণের দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতির প্রতি ভীতির ফল হিসেবেই এত কিছুর পরও ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। আইএফএম-এর জেনারেল কাউন্সেল সিন হ্যাগান মানিলন্ডারিং বন্ধে একটি বৈশ্বিক আইনি কাঠামো দাঁড় করানোর উপর গুরত্বারোপ করে বলেন, বিশ্বজুড়ে সরকারগুলোকে ‘কালচার অফ ভ্যালুজ’-এর প্রতি মনোযোগী হতে হবে। তিনি বলেন, ‘রুল অফ ল’ মানেই রুল অফ লেজিসলেশন নয়। শুধু আইন পাস করলেই আইনের শাসন কার্যকর হয় না। ওই আইনকে বাস্তবায়ন করার উপযুক্ত সংস্কৃতি সরকারে এবং সরকারের বাইরে চর্চা করতে হবে। মানিলন্ডারিং গবেষণারত প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির কাজের প্রশংসা করে আইএমএফ পরিচালক সিন হ্যাগান আরো বলেন, আগামীতে আইএমএফ মানিলন্ডারিং গবেষণার স্বার্থে এ-বিষয়ক তথ্য প্রদানের আওতা ও সুযোগ আরও বৃদ্ধি করার জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নেবে। আলোচনায় অংশ নিয়ে সেমিনারের একটি পর্বের মডারেটর ও বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্সির পরিচালক (অপারেশন্স) স্টিফেন জিমারম্যান তার নিজের বক্তব্যে বলেন, উন্নয়নশীল দেশের সরকারগুলো অনেক সময় প্রকল্প বাছাইয়ের ক্ষেত্রে প্রাধিকার তালিকায় জনগণের মৌলিক চাহিদার প্রতি গুরুত্ব দেয় না। তিনি বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গণ-সম্পৃক্তবিহীন এই যে প্রকল্প বাছাই, এটাকেও দুর্নীতি বলে বিবেচনা করার সময় এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের আইআরএস-এর ইনভেস্টিগেশন বিভাগের প্রধান মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে পাচারকৃত মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার পুনরুদ্ধারে সংস্থাটির সাফল্যের বর্ণনা দিয়ে বলেন, বিশ্বে যেকোনো দেশ যদি মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চায়, তবে তাদেরকে প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দিতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। দুই পর্বে অনুষ্ঠিত এই সেমিনারের উন্মুক্ত আলোচনা পর্বে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অপরাধের তদন্ত ও বিচারের আওতায় আনার দাবিতে সম্প্রতি নিউ ইয়র্কে সংগঠিত ‘ইন্টারন্যাশনাল কমিটি এগেইনস্ট ফিনান্সিয়াল ক্রাইমস ইন বাংলাদেশ’-এর মুখপাত্র কাউসার মুমিন বলেন, জাতিসংঘের গবেষণা তথ্য মোতাবেক টেকসই উন্নয়ন লক্ষ যথাসময়ে অর্জনের জন্য আগামী ১৫ বছর বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোকে প্রতিবছর ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার মূলধন আহরণ করতে হবে। কিন্তু মানিলন্ডারিংয়ের কারণে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশ থেকে গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির তথ্যমতে প্রতিবছর প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে। মুখপাত্র বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে সন্ত্রাসে অর্থায়ন বন্ধে যথেষ্ট উন্নতি করেছে। কিন্তু উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবজনিত মানিলন্ডারিং ক্রমবৃদ্ধিমান হারে অব্যাহত রয়েছে বলে এখনো দৃশ্যমান। তিনি বলেন, উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট মানিলন্ডারিং বন্ধে বিশ্বজুড়ে সরকারগুলোকে একটি আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামোর অধীনে দায়বদ্ধ করতে পারলে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে, মানিলন্ডারিং হ্রাস পেতে পারে বলে আমরা বিশ্বাস করি।’ সেমিনারের প্রশ্নোত্তর পর্বে ‘একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অভাব মানিলন্ডারিংয়ের সুযোগ বৃদ্ধি করে কি না?’ কাউসার মুমিনের এমন প্রশ্নের জবাবে বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্সির কৌশলগত বিষয়াবলীর পরিচালক গ্যালিনা মিখলিন অলিভার বলেন, ‘এ বিষয়ে আলাদাভাবে কোনো পরিসংখ্যান এখনো আমাদের কাছে নেই। তবে আমাদের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সরকারের ধরন নির্বিশেষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ শ্যাডো অর্থনীতিতে চলে যাচ্ছে, তার মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিব ২-৩ শতাংশ বৃদ্ধি করা সম্ভব। সমাপনী বক্তব্যে বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্ট লিওনার্ড ম্যাক্কার্থী বলেন, খুব শিগগিরই বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট এই সেমিনারের মতামতগুলো নিয়ে ব্যাংকের বিভিন্ন অঙ্গসংস্থার প্রধানের সঙ্গে সাইলেন্ট লাঞ্চের আয়োজন করবেন। এই মতামতগুলো দ্রুত বাস্তবায়নে তার অফিস কার্যকর ভূমিকা রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ম্যাক্কার্থী বলেন, দুর্নীতি ও মানিলন্ডারিং বন্ধে বিশ্বব্যাংক এতদিন শুধু লিপসার্ভিস দিয়ে এসেছে বলে ব্যাংকের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আছে, আমরা দ্রুত এর অবসান চাই। ভাইস প্রেসিডেন্ট ম্যাক্কার্থী বিশেষজ্ঞ এবং সিভিল সোসাইটি পর্যায়ে এ বিষয়ে আরো জোরালো ভূমিকা রাখার পরামর্শ দেন।
অর্থনৈতিক দুর্নীতি বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি

November 12, 2016