অপরিচ্ছন্ন পুকুরে চলছে মাছের পোনা চাষ-কুমিল্লা বুড়িচং মৎস্য বীজ উৎপাদন খামারের বেহাল দশা

এম এস শফি: সব মিলিয়ে ৮ টি পুকুর। বুড়িচং মৎস্য বীজ খামারে। তবে সেখানে বর্তমানে মাছের পোনা বিক্রি করছে বলে জানান সংশ্লিস্ট কর্মকর্তা। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেল একটি পুকুরেও পোনা বা মাছ নেই। সবগুলো পুকুরই ঝোঁপ-ঝাড়ে পরিপূর্ণ। সেইসাথে অপরিচ্ছন্ন আর অপরিস্কার। একটি সরকারী প্রতিষ্ঠানের কতটুকু বেহাল দশা হলে সেটা সংশ্লিস্ট কর্মকর্তাদের নজরে পড়বে সেটা চোঁখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবেনা কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলা সরকারী মৎস্য বীজ উৎপাদন খামারের ভিতরের চিত্র। বিশাল এলাকা নিয়ে নির্মিত এই খামারটি অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। খামারে ৮ টি পুকুর থাকলেও কোনটাতেই নেই মৎস্য বীজ বা পোনা লালন-পালনের কোন লক্ষণ। আবার সংশ্লিস্ট মৎস্য কর্মকর্তা ও তার ফিল্ড সহকারীর বক্তব্যপুকুরগুলোতে বড় মাছ পালন করা যাচ্ছেনা চুরির কারনে। এদিকে খামারের অফিস,বসবাসের আবাসিক কোয়ার্টার দেখলে মনে হবে যে কোন মুহুর্তে ধ্বসে যেতে পারে। তাছাড়াও খামারের সীমানা প্রাচীর ও পুকুর ঘেষে লাগানো হয়েছিল সেগুন,মেহগনি,শিশুসহ বিভিন্ন প্রজাতির অনেক গাছ। কালের পরিক্রমায় ওই সকল গাছগুলো বিশাল হয়ে উঠেছে। স্থানীয় প্রভাবশালী কিছু লোক মৎস্য খামারের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কেটে নিয়ে গেছে কমপক্ষে ৩০/৩৫ লাখ টাকা মূল্যের বিভিন্ন প্রজাতির মূল্যবান অর্ধ্বশতাধিক গাছ। নেই কোন থানা বা সংশ্লিস্ট প্রতিষ্টঠানের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে এজন্য কোন অভিযোগ। সরেজমিন বুড়িচং উপজেলা মৎস্য বীজ উৎপাদন খামার ঘুরে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, কুমিল্লা জেলা সদরের উত্তরদিকে সর্বপ্রথম এই উপজেলাটির অবস্থান। উপজেলা সদরের মূল প্রবেশ পথের সড়কের পাশে বুড়িচং খাদ্য গোডাওনের উল্টোদিকে মৎস্য বীজ খামারটির অবস্থান। এখানে একজন খামার ব্যবস্থাপকসহ ৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর দায়িত্ব পালনের কথা থাকলেও বতর্মানে রয়েছে মাত্র ৩ জন। এর বাকী দু’জন হলেন ফিল্ড সহকারী ও অফিস সহায়ক। এটি মৎস্য বীজ খামার হিসেবে পরিচিতি থাকলেও আসলে এখানে রেণু ক্রয় সংগ্রহের মাধ্যমে মাছের পোনা উৎপাদন করে বিভিন প্রতিষ্ঠান,ব্যক্তি বা সরকারী খামারে সরবরাহ করা হয়। তবে সরেজমিন ঘুরে পাওয়া চিত্রে এই খামারে মাছ বা পোনা বিক্রিরও কোন নমুনা চোখে না পড়লেও খামার ব্যবস্থাপক ও ফিল্ড সহকারী একই সুরে বার বার বলেছেন সরকারী এই খামারটি প্রতিবছরই তাদের লক্ষ্য মাত্রা অনুযায়ী উৎপাদন করছেন। কখনো 14459048_1211461638921168_1743126818_nবা কিছু বেশীও উৎপাদন হচ্ছে । এসময় তাদের কাছে বিগত অর্থবছরে কতটুকু রেণু ক্রয় বা তাদের উৎপাদিত পোনার সংখ্যা একাধিকবার জানতে চাইলেও রাজী হননি পেস সংখ্যা জানাতে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বশীল সুত্র জানায়,রেণু থেকে পোনা উৎপাদন করে এই খামার থেকে বিক্রির কথা বললেও সেটা একবারেই মিথ্যা। সুত্র আরো জানায়, যে সকল পুকুরে পোনা রেখে বিক্রির ব্যবস্থা করা হয় সেপুকুরগুলোতে পানি পরিস্কার রাখতে বিভিন্ন ঔষধ ছিটানো ছাড়াও নিয়মিত খাদ্য দেওয়া , জাল টেনে, পানির স্্েরাত তৈরীর মাধ্যমে পোনাগুলোর পরিচর্যা করার কথা। তবে খামারের ৮ টি পুকুরের সবক’টির একটিতে সেটা দেখা যায়নি। সবগুলো পুকুরের পানি অপরিস্কারসহ পুকুরপাড়গুলো ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ। খামার ব্যবস্থাপকের সাথে আলাপ করলে মাঝে মাঝে এসকল কাজের জন্য লোক নিয়োগের কথা বললেও সেটারও কোন সত্যতা মিলেনি। সরেজমিন সেটা অনুসন্ধানে গিয়েও কোন দৈনিক মুজুরীর ভিত্তিতে নিয়োগকৃত কোন লোক দেখা না গেলেও রোববার দুপুরের পর সেখানে ৩/৪ জন শ্রমিককে ঘাস কাটতে দেখা গেছে। অথচ বেলা দেড়টায় যখন অফিস কক্ষে খামার ব্যবস্থাপকের সাথে কথা হচ্ছিল তখনো তিনি কোন দৈনিক লেবার নিয়োগের বিষয়টি স্বীকার করেননি। মৎস্য বীজ খামারের ব্যবস্থাপক তাজুল ইসলাম বলেন, প্রায় ৩ দশমিক ২৯৫ শতাংশ নিয়ে তাদের কমপ্ল্ক্সেটি। মাঝারি আয়তনের ৮ টি পুকুরই তাদের মৎস্য পোনা পালনে ব্যবহৃত হয়। আবার এও বললেন,পুকুরে গাছ পড়ে থাকার কারনে সেগুলোতে জাল টানতে অসুবিধার সৃষ্টি হচ্ছে। সরেজমিন ঘুরে স্থানীয় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বীল সুত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়,৮ টির মাঝে ৬ টিতেই দীর্ঘদিন যাবৎ কোন পোনা পালন হয়না। ঝোপঝাড়ে এসকল পুকুরের চারিপাশ ঘেরা। অফিস ভবনের কাছাকাছি দুরত্বে থাকা দু’টি পুকুরে কিছু পোনা পালন হয়। তবে জানাতে রাজী হননি বিগত অর্থ বছরে তাদের উৎপাদিত কি পরিমান পোনা তারা বিক্রি করেছেন। তাদের বক্তব্যে বারবার যে কথাটি বলেছে,সেটা হচ্ছে,আমাদের এখানে ৮ টি পুকুর। সরকার আমাদের নির্দিষ্ট একটি টার্গেট দেয় সেটার পরিমান ৩ লাখ ১৪ হাজার টাকা। আমরা সেটা ফুলফিল করতে পেরেছি। খামার ব্যাবস্থাপক ও ফিল্ড সহকারী আরো জানান,তারা বছরের শুরুতে রেণু সংগ্রহ করেন। সেটা কখনো সরকারী কখনোবা বেসরকারী বীজ উৎপাদন খামার হতে। এক্ষেত্রে কখনো কখনো তাদের লোকসানের সম্মুখিন হতে হয় বলেও জানান। তারা বলেন,কখনো রেণু কিনে আনার পর সেটাতে পোনা উৎপাদন হয় না। এতে পুরো টাকাটাই তাদের গচ্ছা দিতে হচ্ছে।আর এর দায়ভার তাদের উপর পড়ে বলেও খামার ব্যবস্থাপক জানান। সরকারী খামারের জন্য ক্রয় করা রেণু হতে পোনা উৎপাদন না হলে কেন সেটার জন্য আপনারা দায়ি থাকবেন বিষয়টির ব্যাখ্যা জানতে চাইলে তারা কৌশলে সেটা এড়িয়ে গিয়ে বলেন,অন্যভাবে সেটা ম্যানেজের চেষ্টা চালানো হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক মৎস্য খামারী সুত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়,যেখানে খামারের একটি পুকুর থেকেই এক/দেড় কেজি রেণু চাষ করে তিন লাখের বেশী পোনা উৎপাদন করা সম্ভব,সেখানে ৮ টি পুকুর থেকে কমপক্ষে ৩০/৪০ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব হতো। কিন্তু সরকারের টাকায় পরিচালিত বীজ উৎপাদন খামারের সংশ্লিস্টরা দায়সারাভাবে কাজ করে অধিকাংশ পুকুর বেসরকারীভাবে গোপনে লীজ দিয়ে দেয়। ওই সুত্র আরো জানায়,বর্তমানে বুড়িচং উপজেলা মৎস্য বীজ খামারের যে ৮ টি পুকুর রয়েছে তা থেকে স্বাভাবিক ভাবে মাছের চাষ করলেও বছরে ওই ৮টি পুকুর থেকে কমপক্ষে ১৫ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব হতো। রেণু উৎপাদন করে বিক্রি করলে সেটার পরিমান আরো বেশী হতো।

14459737_1211461582254507 এদিকে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে খামারের ভিতর সীমানা প্রাচীর ও পুকুরের পাড় ঘেষে রয়েছে বেশ কিছু বিভিন্ন প্রজাতির মূল্যবান সেগুণ,মেহগনি,শিশু গাছ। প্রতিটি গাছ বিক্রির জন্য নম্বর করা হলেও দীর্ঘ সময়ে সেটা কার্যকর করা হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুত্র মতে এই খামারের ভিতর কমপক্ষে দেড় শতাধিক মল্যূবান সেগুণ,মেহগনিসহ অন্যান্য প্রজাতির গাছ ছিল। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী লোক খামারের কর্মকর্তা – কর্মচারীদের সহযোগীতায় অর্ধেকেরও বেশী গাছ কেটে নিয়ে গেছে। বর্তমানেও ৮/১০টি গাছ বিভিন্ন পুকুরের পানিতে ডুবে আছে। খামার কর্মকর্তা বলেন,গাছগুলো পুকুরের পানিতে ডুবে থাকায় মাছ চাষে বিঘœ হচ্ছে। তিনি আরো বলেন,আমাদের অফিস রেজিষ্ট্রারে ১১৭ টি গাছের অস্তিত্ব রয়েছে। তবে দায়িত্বশীল সুত্র মতে কমপক্ষে ৭০/৮০ টি মূল্যবান গাছ এরই মাঝে বিক্রি হয়ে গেছে। খামারের মূল অফিসকক্ষসহ প্রতিটি ভবনই বর্তমানে পরিত্যক্ত। কোনটার নেই দরজা জানালা,কোনটারবা দেয়ালের প্লাষ্টার খসে পড়ছে। তবে খামার ব্যবস্থাপক বললেন,অচিরেই এসকল ভবন সংস্কার করা হবে। এছাড়াও সুত্র মতে বেশ কিছু দিন আগে এই বীজ খামারটির হ্যাচারী শেডটি পরিত্যক্ত ঘোষনা করা হলেও কি এক অদৃশ্য ক্ষমতায় সেটা বর্তমানে সংস্কার করা হচ্ছে । খামার ব্যবস্থাপক জানান,১০ লাখ টাকায় হ্যাচারীটি সংস্কার হচ্ছে। এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুত্র মতে ,খামারটির নিরাপত্তা প্রহরী না থাকায় প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে খামারের ভিতর মাদক সেবীদের ভীড় জমে। অনেকটা লোকালয় থেকে দুরে ও নিরাপদ হওয়ায় দিন দিন মৎস্য খামার এলাকাটি মাদক সেবীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বুড়িচং মৎস্য খামারে অনিয়ম,পুকুর পরিত্যক্ত রাখা ,ব্যবহারের অনুপযোগী হওয়া ভবনের সংস্কারের বিষয়ে প্রশ্ন করলে কুমিল্লা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুল কুদ্দুস আকন্দ বলেন,কিগত সময়ে এই বীজ উৎপাদন খামারটি এক প্রকার পরিত্যক্ত ছিল। আমি ২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর দায়িত্ব নেওয়ার পর কুমিল্লার বিভিন্ন উপজেলার ন্যায় বুড়িচং উপজেলা মৎস্য খামারটির সংস্কারে হাত দেই। পুরাতন আবাসিক ও অফিস ভবন বিগত ২০০৫ সালে পরিত্যাক্ত ঘোষনা করা হলেও এখনো ওই ভবনগুলোতেই বসবাস এবং অফিসের কাজ চলছে। তবে আমরা বরাদ্দের জন্য আবেদন করেছি। এছাড়াও এখানকার হ্যাচারীটি এতদিন বন্ধ ছিল,এখন সেটার সংস্কার কাজ চলছে।